ভূঁইয়া নজরুল »
সাফিন আহমেদ ২০১৯ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে ফেল করার পর আর পড়ালেখা করেনি। পরিবারের হাল ধরতে গার্মেন্টসের চাকরিতে প্রবেশ করে। গত বছরের এইচএসসি পরীক্ষায়ও ফরম পূরণ করেনি। ফরম পূরণ করা হলে হয়তো অটোপাশ হয়ে যেতো। যেহেতু এবার আবশ্যিক বিষয়ে পরীক্ষা হবে না তাই এবছর শুধু ফরম পূরণ করলেই সে এইচএসসি পরীক্ষা পাশের সনদ পেয়ে যাবে। সাফিনের মতো গত তিন বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় (২০১৭, ২০১৮, ২০১৯) বিভিন্ন বিষয়ে ফেল করা এমন হাজারো পরীক্ষার্থীর সামনে সুবর্ণ সুযোগ এইচএসসি পাশের। আর এজন্য আগামী ১২ আগস্ট থেকে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে তাদের অংশ নিতে হবে।
গত তিন বছরে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা বিভিন্ন বিষয়ে ফেল করেছে তাদের এবার ফরম পূরণ করার সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ বলেন, ‘পরীক্ষার সুযোগ আগেও ছিল এবারো বিগত বছরের মতো রাখা হয়েছে। তবে এবার তাদের জন্য সুখবর হলো আবশ্যিক বিষয়ে ফেল করা থাকলে শুধু ফরম পূরণ করলেই এইচএসসি পাশ করবে। একইসাথে যদি কেউ নৈর্বাচনিক বিষয়ে ফেল করে তাহলে শুধু ওই বিষয়ে পরীক্ষা দিলে (যদি পরীক্ষা হয়) কিংবা অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিলেই পাশ পেয়ে যাবে। সে হিসেবে তাদের জন্য এটা একটি সুবর্ণ সুযোগ।’
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে ফেল করেছিল ৩৮ হাজার ২৭৩ জন, ২০১৮ সালে ৩৬ হাজার ১০৩ জন এবং ২০১৭ সালেও একই হারে ফেল করেছিল। ২০২০ সালে অটোপাশের কারণে যারা ফরম পূরণ করেছে তাদের সবাই পাশ করেছে। তাহলে সে হিসেবে গত তিন বছরে প্রায় এক লাখের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে যারা বিভিন্ন বিষয়ে ফেল করেছিল। এবারের ফরম পূরণ প্রক্রিয়ায় তারা শুধু ১৭০ টাকা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করলেই পেয়ে যাবে এইচএসসি পাশের সনদ।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ বলেন, ‘২০১৭ সালে যারা ফেল করেছিল তারা ২০১৮ সালে আবারো পরীক্ষা দিয়েছে। সেই হিসেবে গত তিন বছরে এধরনের প্রায় পাঁচ হাজার পরীক্ষার্থী থাকতে পারে।’
এই প্রক্রিয়ায় ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীরা আবারো শিক্ষায় ফিরে আসতে পারবে উল্লেখ করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর অঞ্জন নন্দী বলেন, ‘এতে বিগত সময়ে যেসব শিক্ষার্থী ফেল করার কারণে পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়েছিল কোভিড পরিস্থিতিতে তারা আবারো শিক্ষায় ফিরে আসার একটি সুযোগ পাচ্ছে। এটা শিক্ষার জন্য অবশ্যই একটি পজিটিভ দিক।’
শহরতলীর শিক্ষার্থীদের জন্য এ সুযোগ আরো বেশি কার্যকর হবে উল্লেখ করে কর্ণফুলী এ জে চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘শহরের বাইরে স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজিতে ফেলের হার বেশি থাকে। একইসাথে বিভিন্ন আবশ্যিক বিষয়েও ফেল করে থাকে। যেহেতু এবার আবশ্যিক বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে না। শুধু তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। তাই এবার পাশ করা অনেক সহজতর হবে। আর শুধু আবশ্যিক বিষয়ে যদি কেউ ফেল করা থাকে তাহলে তো ফরম পূরণ করলেই এইচএসসি পাশের সনদ পেয়ে যাবে।’
এদিকে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এইচএসসি ফরম পূরণের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞপ্তিতে এবারই প্রথমবারের মতো অনলাইন পদ্ধতিতে ফরম পূরণ কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এবার শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক কাউকে প্রতিষ্ঠানে যেতে হবে না।
কিভাবে হবে ফরম পূরণ?
শিক্ষাবোর্ড থেকে সম্ভাব্য পরীক্ষার্থীদের তালিকা অনলাইনে দিয়ে দেয়া হবে। সেই তালিকা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ফরম পূরণেরর জন্য শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত করবে। একইসাথে প্রতিষ্ঠান তাদের কাছে কতটাকা পাবে (সর্বোচ্চ ২৪ মাসের বেতন) তা নির্ধারিত ঘরে লিখবে। শিক্ষাবোর্ড এই টাকার সাথে বোর্ডের প্রাপ্য (বিজ্ঞান বিভাগ-১১৬০, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ- ১০৭০) টাকা যুক্ত করে শিক্ষার্থীর মোবাইল নম্বরে মেসেজ পাঠিয়ে দেবে। শিক্ষার্থী সেই অনুযায়ী টাকা অনলাইনে (বিকাশ, নগদ, রকেট, সোনালী ব্যাংক ইসেবাসহ বিভিন্ন মাধ্যম) টাকা জমা দেবে। আর এভাবেই সম্পন্ন হবে ফরম পূরণ প্রক্রিয়া।
বাড়তি টাকা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ বলেন, এই পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি টাকা নিতে পারবে না। ফি এর মধ্যে তারতম্য হলে শিক্ষার্থী অনলাইনে নির্ধারিত বক্সে তা আপত্তি জানাতে পারবে। এতে আমরা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।
ডিজিটাল এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর শিক্ষার্থীর পেছনে ঘুরতে হবে না জানিয়ে বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ জানান, প্রতিষ্ঠানের পাওনা জমা না দিলে ফরম পূরণ করা যাবে না। এতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় নিয়ে আর সমস্যা হবে না। শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য কলেজের অ্যাকাইন্টে পাঠিয়ে দেবে।
কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফরম পূরণের সময় বাড়তি অর্থ আদায় নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফরম পূরণে আধুনিক এই প্রযুক্তি ব্যবহারকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর বাড়তি অর্থ আদায় বন্ধ করা যাবে। একইসাথে এসএসসি’র ফরম পূরণ এবং ভর্তি কার্যক্রমেও এধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ বলেন, অনলাইন এই পদ্ধতি আগামীতে আরো আধুনিকায়ন হবে। তাই বাড়তি অর্থ নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
২০২০ সালে পাশ করা শিক্ষার্থীরা দিতে পারবে মানোন্নয়ন পরীক্ষা
গত বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে সকলকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে সেই ফলাফল দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই ফলাফলে যদি কেউ অসন্তুষ্ট থাকে তাহলে সে এবার মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিতে পারবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ বলেন, ‘মানোন্নয়নের জন্য একজন শিক্ষার্থীকে সব বিষয়ের ( তিনটি নৈর্বাচনিক) জন্য ফরম পূরণ করতে হবে। যদি সাবজেক্ট ম্যাপিং এ বেশি নম্বর পায় তাহলে হয়তো গত বছরের চেয়ে এবার জিপিএ পয়েন্ট বাড়বে। তাই বিধি অনুযায়ী মানোন্নয়ন পরীক্ষার সুযোগ রাখা হয়েছে।’
এদিকে আগামী ১২ থেকে ২৫ আগস্টের মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ কার্যক্রম শেষ করবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং শিক্ষার্থীরা ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ফি প্রদান করতে পারবে।
উল্লেখ্য, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় কোনো আবশ্যিক বিষয়ে পরীক্ষা হবে না। শুধু তিনটি নৈর্বাচনিক (আবশ্যিক) বিষয়ে পরীক্ষা হবে। আগামী ডিসেম্বরে সরকারের পক্ষ থেকে এই পরীক্ষা নেয়া হতে পারে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে যদি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব না হয় তাহলে অ্যাসাইনমেন্ট থেকে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে তাদের মূল্যায়ন করা হবে। ইতিমধ্যে এই তিনটি বিষয়ের অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে ১০টি করে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। তবে চতুর্থ বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট দিতে হবে না। যদি পরীক্ষা না হয় তাহলে ফরম পূরণের টাকা গত বছরের মতো শিক্ষার্থীদের ফেরত দেবে শিক্ষাবোর্ড।