সুপ্রভাত ডেস্ক »
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠছে বাংলাদেশ; উত্তরণের এই পর্ব যেন মসৃণ হয়, সেজন্য বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ ও বিশ্ব ব্যাংকের অংশীদারত্বের ৫০ বছর উদযাপনে সোমবার ওয়াশিংটনে সংস্থাটির সদর দপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণে তিনি এই আহ্বান জানান বলে বাসস জানিয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের এলডিসি মর্যাদা থেকে মসৃণ ও টেকসই উত্তরণ লাভের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
‘একটি মসৃণ উত্তরণের জন্য আমি বিশ্ব ব্যাংককে আমাদের মানব পুঁজি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়ন কর্মসূচিগুলোতে সহায়তা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। সে লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ আইডিএ (যে কর্মসূচি থেকে গরিব দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়া হয়) এ উইন্ডোটি সংরক্ষণ ও অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।’
সরকারের ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বানও জানান প্রধানমন্ত্রী।
জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়া শেখ হাসিনা এদিন বিশ্ব ব্যাংক সদর দপ্তরে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন। এরপর অনানুষ্ঠানিক এক মতবিনিময় সভার পর ‘বিশ্ব ব্যাংক-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের ৫০ বছরের প্রতিফলন’ শীর্ষক মূল অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি।
ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ঋণদাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংকের কাছে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট পরামর্শ রেখেছেন।
২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে যে লক্ষ্য সরকার ঠিক করেছে, তা অর্জনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করব, বিশ্ব ব্যাংক আগামী বছরগুলোতে আমাদের ভৌত ও সামাজিক উভয় খাতে মেগা-প্রকল্পগুলোতে সম্পৃক্ত হবে।’
বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে জাতীয় আকাক্সক্ষার সঙ্গে জাতিসংঘের এসডিজির যে সমন্বয় করেছে, তা তুলে ধরেন তিনি।
‘এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের বর্ধিত, ছাড় দেওয়া এবং উদ্ভাবনী অর্থায়নের জরুরি প্রত্যাশা রয়েছে।’
মহামারী, যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উন্নয়নশীল অর্থনীতির বেশিরভাগ দেশকে যে গুরুতর চাপের মধ্যে ফেলেছে, তাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, মহামারী ও সশস্ত্র সংঘাত থেকে উদ্ভূত একাধিক সঙ্কট সত্ত্বেও কিছু উন্নয়ন অংশীদার তাদের ঋণের খরচ ও সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে।
‘আমি বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের এর কার্যকর বিকল্প খুঁজে বের করার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে আমাদের মতো অর্থনীতির দেশগুলো উদ্ভুত চ্যালেঞ্জগুলো আরও ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারে।’
বিশ্ব ব্যাংক সদর দপ্তরে বিশ্ব ব্যাংক-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের ৫০ বছরের প্রতিফলন’ শীর্ষক মূল অনুষ্ঠান হয় সোমবার।
জলবায়ু ক্ষতি কাটাতে বিপন্ন দেশগুলোকে প্যারিস চুক্তির অধীনে অর্থায়নের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তার ঘাটতি পূরণে বিশ্ব ব্যাংককে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতিতে বিশ্বব্যাপী যে বাংলাদেশ ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠেছে, তা বিশ্ব ব্যাংকের সামনে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি।
বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর চাপ বহন করে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্ব ব্যাংককে আমাদের মানবিক প্রচেষ্টায় যোগদানের জন্য এবং রোহিঙ্গা ও তাদের সম্প্রদায়ের জন্য ৫৯০ মিলিয়ন ডলার অনুদানের জন্য ধন্যবাদ জানাই।’
বিশ্ব ব্যাংক সদর দপ্তরে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। সংস্থার প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এবং সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু, ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
এই অনুষ্ঠান আয়োজন এবং আমন্ত্রণের জন্য বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট মালপাসকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক এই সংস্থায় অনেক বাংলাদেশিকে কাজ করতে দেখে তিনি আনন্দিত হয়েছেন।
তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংক একটি নেতৃস্থানীয় উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশকে ধারাবাহিকভাবে সহায়তা করে আসছে। বিশ্ব ব্যাংকের আইডিএ কর্মসূচির অধীনে বাংলাদেশের জন্য বর্তমান বৈদেশিক সহায়তার প্রায় ৩২ শতাংশ অবদান রাখে। এছাড়া আইএফসি এবং এমআইজিএ বেসরকারি খাতকেও সহায়তা করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখানে (বিশ্ব ব্যাংক) আমার উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে, আমরা বিশ্ব ব্যাংকের প্রতি আমাদের আস্থা বজায় রেখেছি। আগামী দুই দশকে আমাদের সাফল্য নির্ভর করবে আমাদের সম্মিলিত সক্ষমতা এবং ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই উপায়ে উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলি অতিক্রম করার প্রচেষ্টার উপর।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের কাজ করার কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘গত দেড় দশকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুষ্ঠু সামষ্টিক অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয়গুলির জন্য বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। টানা তিন মেয়াদে জনগণ ও দেশের সেবা করার সুযোগ লাভের জন্য আমি আমাদের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ।’
মহামারীর রাশ টানতে গণটিকাদান এবং এর প্রভাব থেকে অর্থনীতি উদ্ধারে ২৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা কর্মসূচির কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব সম্পদে পদ্মা বহুমুখী সেতুর সমাপ্তি এবং গত বছর এর উদ্বোধন সম্ভবত আমাদের সহনশীলতা ও সাফল্য অর্জনের সেরা উদাহরণ।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, যার জিডিপি ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
‘আমাদের অর্থনীতি গত এক দশকে গড়ে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহামারীর ঠিক আগে এটি ৮.১৫ শতাংশে পৌঁছে। এর ফলে ২০২২ সালে মাথাপিছু আয় ২,৮২৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। ২০২২ সালে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০০৬ সালে ছিল ৪১.৫ শতাংশ।’
সামাজিক সুরক্ষায় জাতীয় বাজেট বরাদ্দ ৪০ গুণ বাড়ানোর কথা বলার পাশাপাশি সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর কথাও বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে আমরা প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে বিনা খরচে বাড়ি দিয়েছি এবং আয় সংস্থানমূলক দক্ষতা ও সহায়তা দিয়েছি। প্রতিটি বাড়ির দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা এবং বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার আঞ্চলিক দেশগুলোর তুলনায় বেশি হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার সম্প্রতি আমাদের জাতীয় জিডিপিতে নারীদের গৃহস্থালির কাজ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
বাংলাদেশকে আঞ্চলিক অর্থনীতির কেন্দ্রে পরিণত করতে সরকারের কাজ করে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি, যা ২০৩০ সালের মধ্যে আনুমানিক ১০ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশ্বের শতাধিক সেরা সবুজ কারখানার অর্ধেকেরও বেশি এখন বাংলাদেশে রয়েছে।’
২০৪১ সালের মধ্যে একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে সরকার এখন কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর লক্ষ্য ডিজিটালি নাগরিকদের ক্ষমতায়িত করা; একটি জ্ঞানভিত্তিক নগদ অর্থ লেনদেনহীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা এবং একটি অধিকার-ভিত্তিক ন্যায়সঙ্গত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়া।
বিশ্ব ব্যাংকের এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব আহমেদ ওয়াজেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান উপস্থিত ছিলেন।