সুপ্রভাত ডেস্ক »
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সুপারিশে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি।
এর আগে অনাস্থা ভোট নিয়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার পর পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচন দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
নিয়ম অনুযায়ী নব্বই দিনের মধ্যে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন হবে। এই সময়ে অবশ্য ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। তবে মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সোমবারই পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার ওই প্রস্তাবের বিষয়ে ভোটাভুটি করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেছেন, বিরোধীদের আনা প্রস্তাবটি সংবিধান সম্মত নয়।
ভোটাভুটি হলে ইমরান খান হেরে যাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
ইমরান খান অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে তাকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহায়তায় ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে বলে পর্যবেক্ষকরা বলছেন।
তার রাজনৈতিক বিরোধীরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। তার জোট সরকারের বেশ কয়েকজন সহযোগী বিরোধীদের দলে যোগ দিয়েছে।
পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে হলে ইমরান খানকে অন্তত ১৭২ জন এমপির সমর্থন পেতে হবে। এর মধ্যে তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের আসন সংখ্যা ১৫৫, তার সাথে আরো আছে তার কোয়ালিশন অংশীদারদের সমর্থন।
পরিষদে মোট আসন সংখ্যা ৩৪২টি।
অন্যদিকে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ সহ পাকিস্তানের বিরোধীদলগুলোর মোট আসন সংখ্যা হচ্ছে ১৬৩।
পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের স্পিকারকে অনাস্থা প্রস্তাব পাবার সাত দিনের মধ্যে ভোটাভুটি করতে হয়।
যেভাবে পাকিস্তানে এই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্ভবত তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে মি. খানকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অপসারণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তানের বেশ কিছু বিরোধী দল।
গত ২৮শে মার্চ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে বিরোধী দলের নেতারা।
গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকটা ঝড় বয়ে গেছে, যার ধারাবাহিকতায় ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি (পিটিআই)’র বেশ কয়েকজন সদস্য দল ত্যাগ করেন। ফলে বিরোধী শিবির বেশ ভারী হয়ে উঠেছে।
ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের জনসমর্থন হারিয়েছে দেশের অভ্যন্তরে চড়া মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়তে থাকার কারণে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের পাকিস্তান অংশের পরিচালক উজাইর ইউনিস বলেন, “উদাহরণস্বরূপ, জানুয়ারি ২০২০ থেকে মার্চ ২০২২ পর্যন্ত ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭%, সেখানে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৩%।”
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কের – অনেকেই মনে করেন যা ইমরান খানের রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনের মূল চাবিকাঠি, যদিও মি. খান ও সেনাবাহিনী দুই পক্ষই এই বিষয়টি অস্বীকার করেন – ক্রমাবনতি ইমরান খানের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে মূল কারণ।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন বর্তমান সংকটের শুরু অক্টোবরে, যখন মি. খান পাকিস্তানের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’এর নতুন প্রধানের নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান।
বিশ্লেষক আরিফা নূর মনে করেন, পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব সবসময়ই ছিল।
পাকিস্তানের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে প্রায় অর্ধেক সময় দেশটির সেনাবাহিনী সরাসরি দেশ শাসন করেছে। কিন্তু সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদের অপসারণের বিষয়টি নিয়ে সরকারের সাথে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক গবেষক আবদুল বাসিত মনে করেন, ইমরান খানের ‘আত্মাভিমান’ ও ‘অনমনীয়তা’ এই দ্বন্দ্বকে জনসম্মুখে নিয়ে এসেছে – যে দ্বন্দ্ব নিয়ে সবসময় লোকচক্ষুর আড়ালেই আলোচনা চলতো।
“ইমরান খান সেনাবাহিনীর টেনে দেয়া সীমারেখা অতিক্রম করেছেন। পরবর্তীতে যখন থেকে তিনি সেনাবাহিনীর পছন্দের লোককেই নিয়োগ দেন, তখন থেকে তার পতনের শুরুটা হয়,” বলেন তিনি।
তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও মি. খান দুই পক্ষই নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
ইতিহাসে তৃতীয়বার অনাস্থা ভোট
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর আগে দুইবার দায়িত্বরত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়েছে।
তবে সেই দুইবারই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীরা – ১৯৮৯ সালে বেনজীর ভুট্টো এবং ২০০৬ সালে শওকত আজিজ – দায়িত্বে থেকে যেতে সক্ষম হন।
কিন্তু পাকিস্তানের বর্তমান সংসদীয় সমীকরণ বলছে এই দফায় ইমরান খান বড় ধরণের পরাজয়ের সম্মুখীন হবেন – এমনকি তার নিজের দলের ভেতরের ভিন্ন মতাবলম্বীরা ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ না করলেও।
সরকার সুপ্রিম কোর্টের একটি রুলের জন্য আবেদন করেছে, যেটি বিদ্রোহ বিরোধী আইনের অধীনে ভিন্ন মতাবলম্বীদের শুধু ভোট দেয়া থেকেই বিরত রাখবে না, তাদের সংসদ থেকেও আজীবন নিষিদ্ধ করবে।
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা মিত্রদের সাথে বৈঠক করছেন, আর প্রচার করছেন যে তারা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।
বিশ্লেষক উজাইর ইউনিস মনে করেন, ইমরান খান তার মিত্রদের সাথে সমঝোতায় ব্যর্থ হয়েছেন, এবং তিনি যদি ‘আশ্চর্যজনকভাবে এই পরিস্থিতি উৎরে যান’, তবুও তিনি যথেষ্ট অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যেই থাকবেন।
তিনি বলেন, “আমার মনে হয় নির্ধারিত সময়ের আগে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে তাকে। কোনওভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যদি তিনি ক্ষমতায় টিকেও যান, তাহলে যতদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য তার ওপর আরও বেশি চাপ আসবে।”
বিশ্লেষক আবদুল বাসিতও মনে করেন যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনওভাবে ক্ষমতায় টিকে গেলেও ‘পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে’ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে তাকে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা