সুপ্রভাত ডেস্ক »
ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার চাপিয়ে দেওয়া এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের সংকট হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
ফলে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে তাতে বাংলাদেশের বিল পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি যুদ্ধের কারণে পণ্যবাহী জাহাজগুলো এখন কৃষ্ণসাগর এড়িয়ে চলতে চাইছে। ফলে শিপমেন্ট বাধাগ্রস্থ হওয়ার শঙ্কাও তাদের। অনেক ক্ষেত্রে অর্ডারও বাতিল হতে পারে।
বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, “এই যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বেশ সংকটে পড়েছে। প্রথমত রাশিয়া থেকে পাওনা পেতে আমাদের সমস্যা হবে। দ্বিতীয়ত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে কাঁচামালের দামও বেড়ে যাবে। তৃতীয়ত রাশিয়া-ইউক্রেন তো ইউরোপের খুব কাছে। এখন সাগরে বিধিনিষেধ আসলে শিপমেন্টে তো ঝামেলা হবেই। ফলে আমাদের অনেক অর্ডার বাতিলও হয়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অর্ডার বাতিল না হলেও পণ্য পাঠাতে আমাদের খরচ অনেক বেশি হবে। সব মিলিয়ে বড় ধরনের সংকটে আমরা পড়তে যাচ্ছি।”
রাশিয়া থেকে গমসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। দেশে বছরে গমের মোট চাহিদার ৭০ লাখ টনের মধ্যে ৩৫ লাখ টন আসছে রাশিয়া থেকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে, ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য, টাকার অংকে প্রায় ৫ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এই রপ্তানির মধ্যে তৈরি পোশাক সবচেয়ে বেশি। এসময়ে আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য (প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা), যার বেশিরভাগই খাদ্য পণ্য। তাছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানির নতুন বাজার হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে রাশিয়াকে। বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের প্রভাব এর মধ্যেই পড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার ওপর।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর নির্বাহী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে, যা অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত। এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশে খুব একটা প্রভাব এখনও না পড়লেও পণ্য পরিবহন খরচ আরো বেড়ে যেতে পারে। ফলে শিল্পের কাঁচামালসহ সকল পণ্যের দাম বৃদ্ধিরও আশংকা করছি আমরা। কারণ বিশ্বের যত জ্বালানি রপ্তানি হচ্ছে তার ১০ শতাংশ আসছে রাশিয়া থেকে।”
যুদ্ধ দীর্যায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “বিশ্বব্যাপী কিছু প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। গম আর জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। প্রত্যাশা করা হয়েছিল, এবছরের মাঝামাঝি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ৬৫ থেকে ৭০ ডলারে নেমে আসবে। কিন্তু এই সংঘাতের কারণে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম আরো বেড়ে গেলে টাকার মান কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
সংঘাত দীর্ঘমেয়াদে চলমান থাকলে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব যে ধরনের বিধি নিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে তার প্রভাব ব্যাংকিং লেনদেন, প্রযুক্তি ও কারিগরি বিভিন্ন খাতে পড়বে। খাদ্য পণ্যের দাম আরো বেড়ে যেতে পারে। ফলে আমাদের সরকারকে এসব বিষয় মাথায় নিয়েই পদক্ষেপ নিতে হবে।”
রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়গুলো প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে বলেছে, রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য চলবে। বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশন নির্মাণ করছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় এ প্রতিষ্ঠানটি পড়লে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে । সম্প্রতি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ রাশিয়ার সঙ্গে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্য রয়েছে, তা চলমান থাকবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি কার্যক্রম স্থগিত রেখেছেন উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা। ফলে এই মুহূর্তে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানি কার্যক্রম স্থগিত আছে। পণ্যের এলসি ও শিপমেন্টও বন্ধ রাখা হয়েছে। তিন দেশের আমদানি ও রপ্তানিকারকেরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সূত্র : ডয়চে ভেলে