আনোয়ারুল হক নূরী »
শিশুকিশোর সাময়িকী আলোর পাতা অক্টোবর-ডিসেম্বর ২৫ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এ সংখ্যায় ২টি কিশোর কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ, ৬২টি কিশোর কবিতা, ২টি গ্রন্থালোচনা ও ছোটদের লেখা স্থান পেয়েছে।
কিশোর কবিতা নিয়ে প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছেন কবি অরুণ শীল। বেশ তথ্যবহুল ও তত্ত্বপুর্ণ লেখাটি ভাষার সারল্যে সবার ভালো লাগবে এ প্রতীতী নিঃসন্দেহে করা যায়। দ্বিতীয় প্রবন্ধটি লিখেছেন কবি সাঈদুল আরেফীন। কিশোর কবিতার মানুষ না হলেও কবি সাঈদুল আরেফীন বেশ শ্রমনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রবন্ধটি পড়ে কিশোর কবিতার পাঠক ও লেখকমাত্রই কিশোর কবিতার রূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবেন।
তারপর রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে কিশোর কবিতা। প্রতিটি কবিতাই স্ব স্ব কবির শক্তিমত্তায় অতুলনীয়। এই ঝাঁকের প্রথম কবিতা আহসান মালেকের ‘টান’।
‘কলুর বলদ দিন রাত্রি টানে তেলের ঘানি।
হাওয়ারটানে উড়তে থাকে মেঘের আঁচলখানি।’ এরপর
কিশোর কবিতার বরণ্যকবি সুজন বড়ুয়া
রিনিঝিনি শব্দে নূপুরে বাজিয়েছেন এভাবে, ‘যেখানে স্নিগ্ধ সব কিছু মোহনীয়/ পাখিরা এমন দেশকেই ভালোবাসে,/ এমন দেশই পাখিদের বড় প্রিয়/ এমন দেশেই ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে।’
সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার কিশোর মনের আনন্দ বাঁশির সুর তুলেছেন,
‘তুমি আমায় শিখিয়েছিলে প্রাণের বর্ণমালা/ ছোট্ট বেলায় নিয়েছিলে আমাকে পাঠশালা।’ এমরান চৌধুরী শব্দের প্রাণময় অনুরণন তুলেছেন, ‘গুবাক তরু নুইয়ে গলা নিত জলের ঘ্রাণ।
দাড়কানারা দিত তখন এক তারাতে টান।’
আজ কিন্তু দাড়কানারা হারিয়ে গেছে। হারায়নি শুধু কবিতা থেকে। দাড়কানারা কবিতাপ্রিয়ছিল বুঝি? এরপর উৎপল কান্তি বড়ুয়া অপুর্ব শৈলীতে তুলে ধরেছেন বান্দরবানের অপার সৌন্দর্য,
‘নিরিবিলি ছিমছাম অপরূপ সাজে।
এখানে আকাশ নামে পাহাড়ের ভাঁজে।’
ছড়ার ঝরনা জাহাঙ্গীর আলম জাহান। কবিতায়ও মাতিয়ে যান মায়াবী সব শব্দমালায়, ‘কিংবা যদি হই কখনো
দূর আকাশের তারা, /দুষ্ট বাঁধনহারা/
চিনবে তখন আমায় বল কারা?
জসীম মেহবুব মায়ের ছবিটি এঁকেছেন অন্য রকমভাবে। কিশোর ছুঁই ছুঁই
মনের কল্পনা আর বাস্তবতার সংমিশ্রণে এক অনন্য অনুভূতির প্রকাশ, ‘আকাশের মেঘ এঁকে ঝরিয়ে বাদল/ ফোটাব তোমার মুখে হাসি খলখল।’ ফারুক নওয়াজ যার সরস শব্দের সরস গাঁথুনি মন টানে। ভাবের সারল্যে কবিতা উন্নীত হয়কে অনন্য মহিমায়। তিনি লিখেন, ‘ঝিনিক ঝিনিক ঝিঁঝিঁর মেয়ে না যদি দেয় সাড়া/
ভাবনা কি আর পাখনা মেলে পূর্নিমা রাত ছাড়া।’ কিশোর কবিতা যার হাতে হয়ে ওঠে সাবলীল, উৎসারিত হয় শতধারায় তিনি রাশেদ রউফ। তাঁর সড়ক তুমি, ‘শত্রু কেন হবে’ শীর্ষক কবিতার দুটো অসাধারণ লাইন এরকম, ‘যে তুমি হও সূর্য-সাথী, ভালো লাগার চাঁদ/ সেই তুমি ঠিক কখনো হও শত্রু-মরণফাঁদ।’
আজিজ রাহমান-এর কবিতা একটু আলাদা নজর কাড়ে। তিনি লিখেছেন,
‘বৃষ্টি ভেজা আলোর গাছে, /দেয় উঁকি রঙ ঝলমলে, /সবুজ রঙের ঢেউ তোলে কেউ/
সবুজ পাতার অঞ্চলে।’
মিজানুর রহমান শামীম অনুপ্রাসের অনন্য কারিগর। তাঁর কবিতায় থাকে অসাধারণ যতো চিত্রকল্প। ‘এই শাড়িটির জমিন ছুঁয়ে /মেঘের মিনার /নদীর কিনার,/রুপোর দিনার /লাল সবুজের টিপ।’
আবুল কালাম বেলালের কবিতায় থাকে ছোটগল্পের মত নাটকীয়তা। কবিতাকে গল্প আকারে উপস্থাপন করেন তিনি।
জাদুর পরশ কবিতায় আবুল কালাম বেলাল লেখেন, ‘আঁকছে আরও কত ছবি কত ইতিহাস /ভালোবাসার রঙ তুলিতে সোনালি মন চাষ /দুর মঙ্গলের উড়ো খবর পাতালপুরীর রূপ/ কালি ছাড়া বুনছে কাচে নিরালা নিশ্চুপ।’
জাকির হোসেন কামাল শব্দচয়ন বেশ চৌকস।যেমন, ‘মা মানে কি মায়াবী রাত ভোর কুয়াশায় ঢাকা /কিংবা কুসুম সবার মনের চিত্র পটে আঁকা।’
নিটোল কিশোর কবিতা কর্মী সনজিত দে। তিনি লিখেছেন, ‘সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘন সবুজ ঘাসে/ আমার গায়ের চিত্র দেখে সূর্য মামা হাসে।’
বাসুদেব খাস্তগীরের কবিতা স্বকীয় বৈভবে ভরপুর। যেমন, ‘কোন উঠোনের বিশালতায় মন উড়ে একটানা/ উত্তরটা কার জানা? /অসীম আকাশ স্বপ্নটা দেয় জ্বলে। /নিজের কাছে প্রশ্ন এলে উত্তরও তার মেলে।’ অমিত বড়ুয়ার কবিতা সহজেই সবার মন টানে। যেমন, ‘মাঝির গানে মন উদাসী হয় /ঘরের ছেলে আর কি ঘরে রয় /দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে যেতে /আনন্দে সে উঠল দারুণ মেতে।’
আলোচ্য সংখ্যার সবকটি কবিতা বেশ মন মাতানো। কিন্তু সবার কবিতার উদ্ধৃতি দেওয়া মোটেই সম্ভব নয়। সবশেষে
এই রকম একটি পরিচ্ছন্ন কিশোর কবিতা সংখ্যা উপহার দেয়ার জন্য সম্পাদক এমরান চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাই। সে সাথে এ সংখ্যার প্রচ্ছদশিল্পী খ্যাতিমান ছড়াশিল্পী মিজানুর রহমান শামীম আর প্রকাশক রেহেনা চৌধুরীর প্রতিও আমাদের শুভেচ্ছা। আলোর পাতা আরও সুন্দর হোক এই প্রত্যাশা বরাবরই থাকল।





















































