হেলাল উদ্দিন চৌধুরী তুফান »
আমার মা মরহুমা ডা. নুরুন নাহার জহুর ১৯৩২ সালের ১২ ডিসেম্বর বার্মার (মায়ানমার) রেঙ্গুনে আমার নানার কর্মস্থলে জন্ম গ্রহণ করেন। শিশু ও শৈশব কাল কেটেছে রেঙ্গুনে। তিনি ১৯৪২ সালে চট্টগ্রামের সেন্ট স্কলাসটিকাস স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৪৯ সালে গুলএঞ্জার বেগম হাইস্কুল হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এর পর চট্টগ্রাম কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুল এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে এল.এম.এফ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামে জাতিসংঘ কর্তৃক পরিচালিত ফ্যামেলি প্ল্যানিং বিভাগে চট্টগ্রাম জেলার মেডিকেল অফিসার হিসাবে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
কর্ম জীবনের পাশাপাশি তিনি রাজনীতি, সমাজসেবা, সহিত্যিক কর্মকা- ও বিভিন্ন কর্মকা-ে আমৃত্যু সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিলেন। উনার রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৯ সালে যখন উনি চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৫০ সালে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃত হন। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র রাজনীতি থেকে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের জন্ম হওয়ার পর তিনি ১৯৫০ সাল হতে ১৯৮৬ সাল মৃত্যুর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয় ভাবে কাজ করেন। ১৯৫২-৫৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের কার্যকরী সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে মিছিল পরিচালনা করেন।
তিনি তখন তমদ্দুন মজলিশের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফন্ট নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে কর্মকা- করেন এবং নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন পরবর্তীতে ১১ দফা এবং ৬৯ সালের গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সক্রিয় ভাবে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাথে চট্টগ্রাম শহরে আওয়ামী লীগের পুণর্গঠনের সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং কাজ করেন। তিনি ১৯৭৫-৮৬ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য (আমৃত্যু) ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করে গেছেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফন্ট নির্বাচনের কাজ করার সময় আমার পিতা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরীর সাথে পরিচয় এবং পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে বিবাহ হয়।
৬০ দশকে ৬ দফা, ১১ দফা, আয়ুব বিরোধী আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলন টানা ১৯৬০ সাল হতে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ঘোষিত আন্দোলন সংগ্রামে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেন এবং চট্টগ্রামের মহিলাদের নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রামে মহিলাদের সংগঠিত করেন এবং আগ্রাবাদ এবং ও.আর. নিজাম রোডে মহিলাদের যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনি ঘটন করেন এবং ২ মার্চ বিকাল তিনটায় ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বিশাল সমাবেশে চট্টগ্রামের মহিলাদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য ও সমাজ সেবামুলক সংগঠনের সাথে ঘণিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪২ সালে আজান পত্রিকার মুকুল মেলার সদস্যা ছিলেন। এরপর মুকুল ফৌজ এর সদস্যা ছিলেন এবং সক্রিয় ভাবে এই সংগঠনে কাজ করেছেন। ১৯৫১ সালে আমাদের মাহফিল, চাঁদের হাট সংগঠন পরিচালনা করেছেন। ১৯৪৯ সালে নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি (আপোয়া) বর্তমান মহিলা সমিতির চট্টগ্রাম শাখার সদস্য হন। ১৯৫৭ সালে সমাজ কল্যাণ ও স্বাস্থ্য সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৬২ সালে মহিলা সমিতি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় একক ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন (বর্তমান বাংলাদেশ মহিলা সমিতি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ বা বাওয়া স্কুল)। এই স্কুলটির জমিতে আমার বাবা লিজ নিয়ে চাষাবাদ করতেন এবং আমার মা বাবার অনুমতি নিয়ে ঐ জমিতে ১৯৫৭ সালে প্রথমে মহিলাদের জন্য একটি সেলাই শিক্ষা কেন্দ্র চালু করেন এবং পরবর্তীতে নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি (আপোয়া) অফিস স্থাপন এবং ১৯৬২ সালে আপোয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
শৈশব থেকে আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর সাহিত্য চর্চার সাথে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৯ সালে আমার মা যশোর সাহিত্য সংঘ কর্তৃক প্রদত্ত “সাহিত্য রতœ” উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৯-৭০ সাল পর্যন্ত নিজ সম্পাদনা ও উদ্যোগে একুশে সংকলন “রক্তরাঙ্গা ফাল্গুন” সংকলন প্রকাশিত করেন। ১৯৭২ সালে লেখিকা সংঘ ঢাকার কার্যকরী সংসদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন।
আমার মা ডাঃ নুরুল নাহার জহুর একজন ধনাঢ্য পরিবারের কন্যা হওয়া সত্বেও, আমার বাবার সাথে বিবাহ হওয়ার পর, একটি সাধারণ দরিদ্র পরিবারে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক পরিবারের হাল ধরেছিলেন। আমার বাবা জহুর আহম্মদ চৌধুরী ছিলেন একজন অতি সাধারণ মানুষ, জীবনে কখনো লোভ লালসা বা প্রাপ্তির দিকে দেখেন নাই। ১৯৭৫ সালে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকেও উনার মৃত্যুর পর আমাদের ভবিষ্যৎ এর জন্য ন্যূনতম জীবন ধারণের চাহিদা পূরণের জন্য কিছু রেখে যাননি। এমন কি মৃত্যুর পর দিন আমাদের বাসায় বাজারের টাকাও রেখে যান নাই।