অধ্যাপক (ডা.) মাহমুদ আহমেদ চৌধুরী (আরজু)
আমার জন্ম চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকাননের হরিশ দত্ত লেনে। অনেকটা শহুরে জীবনে মানুষ হয়েছি। যদিও সে সময় চট্টগ্রাম শহরটা আজকের মত জনবহুল এবং ব্যস্ততম ছিল না। আমাদের বাসা ছিলো ডিসি হিলের ৩নং গলির ৩ নম্বর বাসাটি। আমার পিতা মরহুম বাদশাহ মিয়া চৌধুরী আমাদের নিয়ে একটি টিনের বাসায় থাকতেন। তখনও সন্ধ্যার সময় পাহাড় থেকে শিয়াল নেমে হুক্কা হুয়া বলত। খুবই ভয় লাগত। কারণ এই না শিয়ালটি বাসায় ঢুকে পড়ে। ঐ শহুরে জীবনে বড় হতে থাকলেও গ্রামের বাড়িতে যেতে খুব ইচ্ছা করত। কিন্তু স্কুল, গৃহ শিক্ষক, আরবী শিক্ষক সবকিছু মিলিয়ে গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হত না। সাধারণত ঈদুল ফিতরের ঈদ আমরা শহরে উৎযাপন করতাম। তবে কোরবানী ঈদে গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হতো। কারণ আমার পিতা কোরবানী ভাইদের সাথে করতে পছন্দ করতেন। আমাদের গ্রামের বাড়ী হাটহাজারী থানার উত্তর মাদার্শা গ্রামে অবস্থিত। অবশ্য আমার পিতা নিজে গ্রামে যেতেন না। আমার মাকে পাঠাতেন। মা’সহ আমরা ভাইবোন সবাই বেশ উৎসব সহকারে গ্রামে যেতাম। তখন গ্রামে যেতে এখনকার মত এতভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। আমাদের একটা বিট্রিশ কোম্পানী নির্মিত চৎবভবপঃ গাড়ী ছিল। আমরা সবাই ঐ গাড়ীতে বোঝাই হয়ে কাপ্তাই রাস্তার পথধরে মদুনাঘাটে যেতাম। পথে আমার মা গনিবেকারী বা লীগ স্টোর (বর্তমানে গুলজার মার্কেট) থেকে গ্রামের আত্মীয়স্বজনদের জন্য কেক, বিস্কুট( বিশেষ করে বেলা বিস্কুট) নিয়ে যেতেন। মদুনাঘাট থেকে হালদা খাল দিয়ে সাম্পানে চড়ে রামদাশ মুন্সীর হাটে আসতাম। সাম্পানে মাঝির দাড়ের ক্যা-কুরুত শব্দ এখনও কানে বাঁজে। তখন রামদাশ মুন্সীর হাটে সপ্তাহে ২ দিন সোমবার ও বৃহস্পতি বার হাট(বাজার) বসতো। হাটে অনেক লোকের সমাগম হত। ওখান থেকে গ্রামের লোক ১ সপ্তাহের জন্য নানা রকম তৈরী তরকারী, মাছ-মাংস কিনে নিতো। আমরা যে দিন গ্রামের বাড়ি আসতাম ঐ দিন আমার মেঝ চাচা মোহাম্মদ মিয়া এবং চাচাতো ভাই বোনেরা আমাদের জন্য ঐ হাটে অপেক্ষা করতেন। পরে সবাই একসাথে পায়ে হেটে গ্রামের বাড়ীতে পৌঁছাতাম। আমার বড় জেঠী মা আমাদের সবাইকে লেবু পাতার শরবত খাওয়াতেন। আমরা সাধারণত ঈদের ১ দিন আগে গ্রামের বাড়ী যেতাম। তখন কোরবানীর গরু কেনা হয়ে যেত। সকালে ভোরে উঠে গোয়াল ঘরে যেতাম কোরবানীর গরু দেখতে। প্রতিযোগীতা থাকত যে কোন গরুটা বড়। চাঁদের রাতে দেখতাম চাচী আম্মারা চালের রুটি বানাতে ব্যস্ত।
ঈদের দিন সকাল বেলায় ঈদের কাপড় পরে বাড়ির পাশে মসজিদের সামনের ময়দানে কোরবানীর ঈদের জামাত হত। ঐ সময় বাড়ীর পুরুষরা সবাই ও আশ-পাশের অনেকে উপস্থিত থাকতেন। মসজিদের ইমাম সাহেব খোৎবার আগে সবাইকে মসজিদের জন্য টাকা পয়সা চাইতো পরে নামাজ শেষ হলে সবাই এর সাথে পারিবারিক কবরস্থানে মুরব্বীদের কবর জেয়ারত করে দৌড়ে যেতাম যেখানে গরু জবাই হবে। আমার মেঝ চাচা ও ছোট চাচা নিজেরাই কোরবানী গরু জবাই করতেন। পরে একটা বড় মাদুর বিছিয়ে গরুর কাটা মাংস একসাথে জড়ো করা হতো। চাচারা ও চাচাতো ভাইরা সবাই মিলে একসাথে মাংস কাটতে থাকে। সাথে অনেক লোকও থাকে। আমিও ছোট একটা ছুরি নিয়ে কাটা মাংসগুলোকে ছোট ছোট টুকরা করতাম। পরে তারা কাজ শেষে মাংস নিয়ে যেতো। আমার বয়সী চাচাতো ভাইরা গরুর চর্বি দিয়ে নারিকেলের মালাতে বা ভাঙ্গা কলসীর মুখে লাগিয়ে পরে তা শুকিয়ে শক্ত করে ছোট বেত দিয়ে ঢোল বাজাতে থাকতো। আমি অভ্যস্ত ছিলাম না বলে পারতাম না। দুপুরের মধ্যে মোটামুটি মাংস কাটাকুটি শেষ হয়ে যেত। কিছু মাংস জবাইয়ের পরে আগেই রান্না ঘরে পাঠানো হত, যাতে করে দুপুরে খেতে পারি।
বিকালের দিকে পাড়ার অনেকের বাসা থেকে রান্না করা মাংস ও চালের রুটি আসত। সবাই মিলে একসাথে কোরবানীর মাংস খেতাম আর বড় ভাইরা বলত কোন বাড়ির মাংস ভাল হয়েছে। ঈদের দিন সন্ধ্যায় অনেক সময় কাঁচা মাংস ও রান্না করা মাংস নিয়ে শহরে চলে আসতাম। অনেক সময় আমরা ঈদের পরবর্তী ২/৩ দিন গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। তখন রাতের বেলায় চাদনী রাতে লুকোচুরি খেলা খেলতাম। পরে আমরা চাচাতো ভাইবোনদের নিয়ে আমার মেঝফুফু জরিনা ফুফুর শ^শুরবাড়ী গরদুয়ারা যেতাম। অনেক মাইল লম্বা রাস্তা হেঁটে পৌঁছতাম। কারণ হাঁটা ছাড়া কোন বিকল্প পথ ছিলোনা। ছোট ফুফুর শ^শুর বাড়ি রাউজানের কাগতিয়া গ্রামে সাম্পানে করে যেতাম। আমাদের বাড়ি থেকে রান্না করা মাংস ও রুটি সাথে করে নিয়ে যেতাম।
ছোট বেলার কোরবানী ঈদের স্মৃতি এখন আমাকে নাড়া দেয়, এখনও গ্রামে গেলে সেই সব স্মৃতি রোমন্তন করতে চেষ্টা করি। পরে অবশ্য আমরা ক্রমান্বয়ে নানাবিধ কারণে শহরে ঈদ উৎযাপন করি। কসাই ডেকে ২/৩ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত মাংস কাটাকুটি শেষ করে দেয়। শহরে যে সকল আত্নীয়স্বজন আছে তাদেরকে মাংস বিতরণ করতাম। এভাবে আমরা ঈদের আনন্দকে ছোট ও সংকীর্ণ করে ফেলেছি।
যখনই কোরবানীর ঈদ কাছে আসে আমার সেই ছোট বেলার দিনগুলো আমাকে স্বরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু পুরনো দিনেতো আরা ফিরে যেতে পারবো না। তবে পুরনো স্মৃতি মনে করে নিজেকে ছেলেবেলার সেই দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি।
লেখক : শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ