ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী »
আজ শোকাবহ ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির জন্য আরো একটি শোকাবহ দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে এ জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যখন সুনিশ্চিত তখন বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধন বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া এক নৃশংস, বর্বোরোচিত ও কাপুরুষতম হত্যাযঞ্জ। ঐ দিন শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক ও চিন্তকগণ এই সুপরিকল্পিত নিধনযজ্ঞের শিকার হন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষকে মেধাশূন্য রাখার জন্যই পরাজয়ের পূর্বমুহূর্তে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার এই নীল নকশা প্রণয়ন করে গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। যা “পোড়া মাটি নীতি” অংশ ছিল। পাক সামরিক জান্তাদের কাছ থেকে অস্ত্র সাহায্য লাভ করে তাদেরই ছত্রছায়ায় এদেশীয় দালাল ও মানবতার শত্রু আধা-সামরিক বাহিনী, আল-বদরের সশস্ত্র ক্যাডাররা এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। অবশ্য ১৯৭১ এর স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’র মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদাররা নির্মম হত্যা চালায় ঢাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর। সেদিনের হত্যাকা-ে অনেক বুদ্ধিজীবী শহীদ হন।
বাঙালির কাক্সিক্ষত বিজয়ের ঊষালগ্œে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের কেন হত্যা করা হলো সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে করি। বুদ্ধিজীবী বলতে সাধারণত সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সঙ্কটকালে বৌদ্ধিক পরামর্শ দানের মাধ্যমে যথার্থ দিক নির্দেশনাকারী প-িত যোদ্ধাদের বোঝায়। অভিধানে বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বৎসমাজকে অনেকাংশে এক করে দেখানো হয়েছে। ঙীভড়ৎফ উরপঃরড়হধৎু-শব্দটিকে এভাবে সজ্ঞায়িত করেছে। ‘‘ঞযব পষধংং পড়হংরংঃরহম ড়ভ ঃযব বফঁপধঃবফ ঢ়ড়ৎঃরড়হ ড়ভ ঃযব ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ধহফ ৎবমধৎফবফ ধং পধঢ়ধনষব ড়ভ ভড়ৎসরহম ঢ়ঁনষরপ ড়ঢ়রহরড়হ” অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী এমন একটি সম্প্রদায় যা জনসংখ্যার শিক্ষিত অংশ দ্বারা গঠিত হয় এবং যারা জনমত গঠনে সক্ষম। এও মনে করা হয় যে, বু্িদ্ধজীবী সম্প্রদায় সমাজের জনমত, রাজনীতি, ও মূল্যবোধকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রের আনুকুল্য নেন না। বুদ্ধিজীবী সংখ্যায় মতদ্বৈধতা থাকায় স্বাধীনতার ৪৯ বছরে ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বুদ্ধিজীবীর নতুন সংখ্যা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রাচীনকাল ও মধ্যযুগ থেকে ভারতবর্ষ ও বিভিন্ন দেশে নানাভাবে বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব ঘটে। ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। এই বিপ্লবেই রুশো, ভলতেয়ার, মন্টেসো ও দিদারো প্রমুখ বুদ্ধিজীবীরা অসামান্য অবদান রাখেন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবে লেনিন, গোর্কি, লুনাচারাস্কি প্রমুখ বুদ্ধিজীবী/চিন্তাবিদগণ ভূমিকা রেখেছেন।
যুক্ত বাংলা ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের প্রভাব তো আছেই। ১৯২০ এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সাহিত্য সমাজ গঠন করে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায় বিকাশের জন্য ‘বুদ্ধির মুক্তি’র আহবান জানান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে ফরাসি বিপ্লবের মহানায়ক নেপোলিয়ন এবং রুশ বিপ্লবের মহানায়ক হলেন লেনিন। কিন্তু তাদের এই বিপ্লবকে সফলতা দানে উপর্যুক্ত বুদ্ধিজীবীরা অনবদ্য অবদান রাখেন। জাতীয় সংগ্রাম ও বিপ্লবের ইতিহাসে মহানায়ক ও জাতীয় নেতারাই বেশি ভূমিকা রাখেন। আমাদের দেশের জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। স্বাধীনতার সোপানে সমাজে জনমত ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছেনÑ মুনির চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান, মাহবুবুল আলম চৌধুরী ও আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখ লেখক, নেতা, বুদ্ধিজীবীরা। মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বীর সেনারা হাতে রাইফেল, স্টেনগান, মেসিনগান, গ্রেনেড প্রভৃতি সমরাস্ত্র নিয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, আমাদের লেখক-বুদ্ধিজীবীরা অস্ত্র হিসেবে কলম ও বক্তব্যকে ব্যবহার করেছেন। অতএব জাতীয় স্বাধীনতা বিজয়ের স্মরণী হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের কাতারে বুদ্ধিজীবীদের অবদানের কথা জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বুদ্ধিজীবীরা সম্মুখ সমরের যোদ্ধা না হয়েও কেন আল-বদর হায়েনাদের রোষানলের শিকার? বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে জনসচেতনতার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বিরাজ করে। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ও বাংলা ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। বুদ্ধিজীবীদের সাংস্কৃতিক চরিত্র ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব মৌলবাদীদের মূল টার্গেট। পাকিস্তানি জান্তাদের উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে দুর্বল করে বাঙালি জাতিকে মেধাহীন জাতিতে পরিণত করা এবং সে উদ্দেশ্য সফল করাই ছিল এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মূল পরিকল্পনা। কারণ মৌলবাদীরা বরাবরই মুক্ত-চিন্তা ও অসাম্প্রদায়িকতা বিরোধী। মধ্যযুগীয় যুদ্ধ ইতিহাসে ‘পোড়া মাটি নীতি’ কৌশল হলো, শত্রুপক্ষের রসদ ধ্বংস করার জন্য পশ্চাদপদ পরাজিত বাহিনীর সম্মুখে সকল রসদ জ্বালিয়ে দিত। ‘৭১’ এর পরাজিত শত্রুরা অনেকটা ‘পোড়া মাটির নীতি’ ন্যায় জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে বেছে বেছে হত্যা করে।
আপাতদৃষ্টিতে বাঙালি জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তান, বুদ্ধিজীবীদের হারালেও বিজয়ের ৪৯ বছরে এজাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। একদিকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি অনেক দেরিতে হলেও রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালাচ্ছে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশ মধ্যআয়ের দিকে এগুচ্ছে। আরো উল্লেখ্য বিষয় হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী এদেশের রাজাকার, হানাদার, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইবুন্যাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার ও রায় কার্যকর করা হচ্ছে। এখনো জঙ্গিবাদ ও উগ্র মৌলবাদীরা তাদের স্বাধীনতা বিরোধী চক্রান্ত ও এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয়। জাতির পিতার ভাস্কর্যকে অবমাননা করার মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরোধীরা আবারও তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। নানা কৌশলে তারা মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলিকে ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সজাগ থাকতে হবে এবং মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী বুদ্ধিজীবীদের অবদানকে স্মরণীয় করতে হলে সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাঙালিকে কাঁদতে হবে।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের দেখানো পথেও হাঁটতে হবে। সবশেষে বলতে চাই, কাঁদো কাঁদো বাংলার মানুষ/কাঁদো বোন ভাই/সোনার দেশের সোনার মানুষ/হারিয়ে গেছে তাই।
লেখক : অধ্যাপক
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়