আবুল হাসানের কবিতায় একাকীত্ব ও শোকের দুই মুখ

পাান্থজন জাহাঙ্গীর »

আবুল হাসান বাংলা আধুনিক কবিতায় এক ব্যতিক্রমী কণ্ঠ। তাঁর কবিতা ব্যক্তিগত বেদনাকে জাতিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করে, এক গভীর মানবিক উপলব্ধিতে পৌঁছে যায়। “পাখি হয়ে যায় প্রাণ” এবং “উচ্চারণগুলি শোকের”—এই দুইটি কবিতা সেই উপলব্ধির দুই দিক। প্রথমটি মানুষের ভিতরের একাকীত্ব ও আত্মবিচ্ছিন্নতার কবিতা, দ্বিতীয়টি হারানো মানুষ ও যুদ্ধোত্তর সমাজের নীরব বেদনার প্রতিফলন। দুটি কবিতাই মিলেমিশে আবুল হাসানের কাব্যচিন্তার সারমর্ম প্রকাশ করে—মানুষ শেষ পর্যন্ত একা, আর জীবনের আনন্দের নিচে সর্বদা শোকের এক স্তর লুকিয়ে থাকে।
“পাখি হয়ে যায় প্রাণ” কবিতায় কবি নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “অবশেষে জেনেছি মানুষ একা।” এই বাক্যটি শুধু তাঁর নয়, মানবজীবনেরও সারসংক্ষেপ। কবি বুঝতে পেরেছেন, সম্পর্ক, স্নেহ, বন্ধন—সবই শেষ পর্যন্ত সময়ের স্রোতে ভেসে যায়। তাঁর ফাতিমা ফুফু, সরজু দিদি, বড় ভাই বা দুলাভাই—সবাই স্মৃতির মানুষ হয়ে গেছে। এই স্মৃতিগুলো কবিকে শান্ত করে না, বরং তাকে নিজের ভেতরে আরও একা করে তোলে। কবিতার প্রতিটি চরিত্র যেন জীবনের কোনো এক হারানো প্রান্তের প্রতীক, আর কবি সেই প্রান্তে দাঁড়িয়ে সময়ের কান্না শুনছেন।
কবিতায় প্রকৃতি ও মানুষ একসঙ্গে মিশে গেছে। নদী, মেঘ, যুঁই ফুল, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি—সবই যেন মানুষের স্মৃতির প্রতিরূপ। কিন্তু সেই স্মৃতি কখনো আর ফিরে আসে না। কবি বলেন, “নিজেরই অচেনা নিজে”—এখানে আত্মপরিচয়ের সংকট স্পষ্ট। মানুষ নিজের মধ্যেই অপরিচিত হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি একমাত্র মুক্তির রূপ দেখেছেন পাখির মধ্যে—“পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ”—যেন সব সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মা উড়ে যেতে চায় অজানা প্রান্তরে।
অন্যদিকে, “উচ্চারণগুলি শোকের” কবিতায় কবির দৃষ্টি বাইরে, সমাজে, মানুষের জীবনে। এখানে একাকীত্ব নয়, আছে হারানোর ইতিহাস। তিনি বলেন, “লক্ষ্মী বউটিকে আমি আজ আর কোথাও দেখি না, হাঁটি হাঁটি শিশুটিকে কোথাও দেখি না।” এই অনুপস্থিতির বর্ণনা আসলে যুদ্ধের পরের দৃশ্য—যেখানে বহু মুখ হারিয়ে গেছে, অথচ সমাজে চলছে উৎসব আর স্বাধীনতার উল্লাস। কবি এই বৈপরীত্যে নিঃশব্দ প্রতিবাদ তুলেছেন। তাঁর ভাষা সরল, কিন্তু প্রতিটি বাক্যের নিচে জমে আছে ক্ষতির ভার।
“কতগুলি রাজহাঁস দেখি, কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি”—এই পঙক্তিগুলোয় আমরা দেখতে পাই আবুল হাসানের সমাজবোধ। মানুষ এখন বেঁচে আছে কিন্তু অনুভবহীন; স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতার ভিতরে মানুষ হারিয়েছে নিজের আত্মীয়তা ও মানবিকতা। কবিতার শেষে তিনি বলেন, “কেবল পতাকা দেখি, কেবল উৎসব দেখি… তবে কি আমার ভাই আজ ঐ স্বাধীন পতাকা?” এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে কবির গভীর শোক। তিনি জানেন, পতাকার উল্লাসের নিচে অসংখ্য অনুপস্থিত মুখ লুকিয়ে আছে—যাদের স্মৃতি ছাড়া স্বাধীনতা সম্পূর্ণ নয়।
দুটি কবিতাই ভিন্ন পরিস্থিতিতে লেখা হলেও তাদের মধ্যে একটি সাধারণ স্রোত আছে—এক ধরনের নিঃশব্দ বেদনা ও সময়ের প্রতি অসহায় মুগ্ধতা। “পাখি হয়ে যায় প্রাণ”-এ মানুষ একা হয়ে পড়ে নিজের ভেতরে, “উচ্চারণগুলি শোকের”-এ মানুষ একা হয়ে যায় সমাজের ভিড়ে। প্রথম কবিতায় একাকীত্ব আত্মিক, দ্বিতীয়টিতে সামাজিক। কিন্তু দুটোই শেষ পর্যন্ত মানুষের অক্ষমতা প্রকাশ করে—মানুষ যা হারায়, তা কখনো ফিরে পায় না।
ভাষার দিক থেকে আবুল হাসানের কবিতা সংযত ও স্বাভাবিক। তিনি শব্দ দিয়ে কাঁদেন না, বরং নীরবতা দিয়ে কাঁদান। তাঁর বর্ণনা কখনো অতিরিক্ত নয়, কিন্তু গভীর। “পাতা ঝরবার মতো শব্দ হতো জলে” বা “শিমুল তুলোর মতো সোনারুপো ছড়াল বাতাস”—এমন চিত্রগুলো তাঁর কবিতায় নীরব অথচ দৃশ্যমান ব্যথার সৃষ্টি করে।
“পাখি হয়ে যায় প্রাণ”-এ কবি সময়ের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পান, আর “উচ্চারণগুলি শোকের”-এ তিনি ইতিহাসের মধ্যে খোঁজেন মানবিকতার চিহ্ন। একটিতে আত্মার নিঃসঙ্গতা, অন্যটিতে সমাজের শূন্যতা—দু’টোই শেষ পর্যন্ত একই সত্যের দিকে নিয়ে যায়: জীবনের গভীরে শোকের সুর লুকিয়ে থাকে।
এই দুই কবিতা মিলিয়ে আমরা আবুল হাসানকে দেখতে পাই এক চিন্তাশীল, নিঃসঙ্গ ও মানবিক কবি হিসেবে। তাঁর কবিতায় বিজয়ের আনন্দের চেয়ে বেদনার মহিমা বেশি। তিনি উৎসবের নয়, নিস্তব্ধতার কবি; তাঁর উচ্চারণে শোক আছে, কিন্তু সেই শোকই মানুষকে সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়।