মো. শামসুর রহমান »
বাঙালি মুসলমানের স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে প্রখ্যাত লেখক আহমদ ছফা বলেছেন, বাঙালি মুসলমানের মন যে এখনও আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্য নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুণ তাঁর মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে। এই মানসিক ভীতি দ্বারা চালিত সমাজ রাষ্ট্র এখনো বিজ্ঞান ভিত্তিক আধুনিকতাকে ধারণ করতে পারে নি হৃদয়ের গভীরে। এ ধারণ করতে না পারার পেছনে শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, ব্যক্তিগত লাভ ক্ষতি প্রাপ্তির প্রবল আকাক্সক্ষার একটা ধান্ধাবাজি চেতনাও কাজ করছে নির্মোহভাবে। তাই, এখানে ধর্ম, আদর্শ, চেতনাকে সহজভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সহজ। আদর্শ-চেতনাকে পুঁজি করে রাতারাতি ব্যক্তি স্বার্থ শতভাগ আদায় করাও অসম্ভব নয়।
দ্বৈত প্রাপ্তির আকাক্সক্ষায় যে মৌলবাদী চেতনা ধর্ম ও অন্যান্য মতাদর্শ আঁকড়ে ধরে দিন দিন ডালপালা বিস্তার করছে, সেটাই সমাজ রাষ্ট্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, অগ্রগতি ও উন্নয়নকে পশ্চাতে ঠেলে দিচ্ছে, তা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন ছিল নির্মোহ বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ। বাহিরে থেকে আধুনিকতার চাকচিক্য ঘেরা এই বঙ্গদেশে যে বুদ্ধিজীবী সমাজ দেখা যায়, তারা প্রকৃতপক্ষে নিঃস্বার্থভাবে বুদ্ধি চর্চা করে না। প্রগতি তাদের বাহ্যিক রূপ হলেও ভেতরটা থাকে ব্যক্তি সমৃদ্ধির চেতনায় পরিপূর্ণ। প্রগতিশীলরা শতভাগ যে প্রগতি ধারণ করে না, সুবিধাবাদী চরিত্র ধারণ করে কখনো ধর্মীয় মৌলবাদ, রাজনৈতিক মৌলবাদ, আঞ্চলিক মৌলবাদ, ভাষাগত মৌলবাদ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাসবাদের সমর্থক হয়ে পড়ে, সেটাই মূলত সর্বক্ষেত্রে উগ্রবাদকে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
প্রগতিশীলদের স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে আহমদ ছফা বলেছিলেন, যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশো ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবি করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। আপন স্বার্থে মায়াবন্ধনে যখন প্রগতিশীলরা সত্য ধারণ ও সত্য উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন সকল অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাংলাদেশে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির পরও উগ্রতা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দলবাজির মহামারি পশ্চাতে ফিরে যাবার শংকা বলে দিচ্ছে আমরা সত্যিকার অর্থে উন্নতির সিঁড়িতে প্রবেশ করতে পারিনি।
স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনা থেকে আমরা বহু দূর সরে গিয়েছি। চেতনা আদর্শ যে বায়বীয় বিষয় নয়, সেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করিনি। আমরা স্বীকার করি বা না করি, বলতে দ্বিধা নেই প্রগতিশীলতা ও রাজনীতির নামে এক শ্রেণিগোষ্ঠীর অপকর্মে ভর দিয়ে এখানে জন্ম নিয়েছে সকল ধরনের উগ্রতা।
সাম্যের সমাজ গড়ার প্রত্যয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্মমূলে থাকলেও সেই সাম্য-শোষণমুক্ত সমাজ রাষ্ট্র নির্মাণ করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। চরম বৈষম্যযুক্ত উন্নয়ন সমাজ রাষ্ট্রকে বহুধা বিভক্ত করে ফেলেছে, যা অস্বীকার করা যায় না। এটি আমাদের সমন্বিত জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির পথে অন্তরায়। বহুধা বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা সত্যিকার অর্থে সুনাগরিক তৈরি করতে পারিনি। আমাদের যে কৃষিভিত্তিক গ্রাম্য সমাজ, তার মর্মটা ধারণ করতে পারেনি আধুনিক শহুরে সমাজ। তাই এখানে চিন্তার জগতে গ্রাম ও সমাজের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সুবিধা যখন এক শ্রেণির মানুষ চেতনা আদর্শের অপব্যবহারের মাধ্যমে কুক্ষিগত করে শোষণ প্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন পশ্চাতে পড়ে থাকা মানুষগুলো সেই শোষণ প্রক্রিয়া থেকে মুক্তির জন্য ¯্রােতের প্রবাহে যা পাচ্ছে, তা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত বিশাল একটা জনগোষ্ঠীকে আধুনিক শিক্ষা ও উন্নয়ন অগ্রগতির আওতায় আনতে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগটা নিয়েছে ধর্ম আশ্রিত মৌলবাদী গোষ্ঠী। আবার প্রবল হতাশাগ্রস্ত যুব গোষ্ঠীর হতাশাকে পুঁজি করে তাদেরকেও বিভ্রান্ত করছে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যুবশক্তির আত্মবিকাশে যতটা সহায়ক ভূমিকা রাখার কথা ছিল, তা না রেখে তারা নিজেদের স্বার্থে তোষামোদি চরিত্রায়ন করেছে। তাই, বলতে হয় উগ্রতার ডালপালা বিস্তারের ক্ষেত্রে শুধু ধর্মীয় দর্শন কাজ করে নাই, অপরাজনীতি সংস্কৃতিও বহুলাংশে দায়ী।
ব্যক্তিগত উন্নয়ন যে সমষ্টির উন্নয়ন নিশ্চিত করে না, সেটি আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ বিগত ৪৯ বছরে অনুধাবনে নিতে পারেনি। শোষণের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন এবং সমৃদ্ধির উচ্ছিষ্টাংশ বিলিয়ে পরকালের তরী পার হওয়ার যে অপসংস্কৃতি এখানে গড়ে উঠেছে, তার স্বরূপ বিশ্লেষণে বলা যায়-ধর্মীয় মৌলবাদ, উগ্রতা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, লুটপাট, দলবাজি পরস্পরের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে অবিচ্ছিন্নভাবে। মুক্তিকামী চেতনা মানুষকে সর্বদা শোষণের শিকল মুক্ত করতে অনুপ্রাণিত করে। সেটা যে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে আসতে পারে, তা আমাদের সুবিধাবাদী প্রগতিশীল ও রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ পশ্চাতে পড়ে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীর অনুধাবনে নিতে পারে নাই। সস্তা রাজনীতির চর্চায় ব্যক্তি সমৃদ্ধির দর্শনের বিপরীতে পেছনে পড়ে থাকা জনগোষ্ঠী তাদের ভাগ্যোন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে কখনো ধমীয় উগ্রতা বা রাজনৈতিক উন্মাদনা। দু’টি যে মৌলবাদের অবিচ্ছিন্ন সূচক, সেটি আমরা স্বীকার করতে চাই কিংবা নাইবা চাই, বাস্তবতা কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারি না। বিশাল গোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে রেখে উন্নয়ন অগ্রগতি সম্ভব নয়, তা আমরা অনুধাবনে কখনো নেয়ার চেষ্টা করি নাই। তাই, রক্ত¯œাত বাংলাদেশে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান, শহর ও গ্রামের উন্নয়নের পার্থক্য, শিক্ষা অর্জনের বৈষম্য, সম্পদ বণ্টনের অন্যায্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। একান্ত নিজস্ব মঙ্গল লাভের ধারণা থেকে স্বজ্ঞানে অন্যকে পশ্চাতে ফেলে রাখলে এক সময় তারাই যে আপনার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে তা বহু আগেই রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করেছিলেন। এধরনের অপকৌশল হিতে বিপরীতে আনার শংকা থেকে তিনি বলেছিলেন, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। অজ্ঞানের অন্ধকারে, আড়ালে ঢাকিছ যারে, তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষ্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে এক ধরনের ধর্মীয় উন্মাদনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেই উন্মাদনা কতটা সঠিক বা বেঠিক তার প্রকৃত চিত্র অনুধাবনে সমষ্টির সুষ্ঠু ভাবনাটুকু ভাবার বিষয়টি বিগত ৪৯ বছরের সুবিধাবাদী ও শঠতাপূর্ণ রাজনীতি ধারণ করতে পারেনি। এখানে ধর্মের নামে অপধর্ম চর্চা যেমন হচ্ছে, তেমনি রাজনীতির নামে অপরাজনীতির চর্চাও হচ্ছে। যে চেতনা ও আদর্শ নিয়ে আমরা মাঠ গরম করি, প্রকৃতঅর্থে সেই চেতনা ও আদর্শ আমরা কতটা মনেপ্রাণে ধারণ করি, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। আমাদের প্রগতিশীলতার নামে সুবিধাবাদী আদর্শ চেতনা চর্চার অপফসলটা নিচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদী অপশক্তি।
এই অপশক্তির অপতৎপরতা রুখে দিতে হলে আমাদের অবশ্যই আদর্শ চেতনা চর্চার ভ্রান্ত বিলাস পরিত্যাগ করতে হবে। বিষয়টি যত দিন আমরা বুঝতে ব্যর্থ হবো, ততদিন অসাম্প্রদায়িক সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে না।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যে অভিন্ন, বাঙালির ইতিহাসে একই সূত্রে গাঁথা সেটি আমরা এখনো সমষ্টির মাঝে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। আহমদ ছফা বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন-আজ থেকে অনেক দিন পরে হয়তো কোনো পিতা তাঁর শিশুপুত্রকে বলবেন, জানো খোকা! আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলো যাঁর দৃঢ়তা ছিল, ছিল তেজ আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন, দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে তাহলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎ¯œারাতে রূপালি কিরণধারায় মায়ের ¯েœহের মতো যে বস্তু আমাদের শান্তি এবং নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জান খোকা তাঁর নাম? শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজনীতি চর্চা করেন, তারা ছফার ন্যায় বঙ্গবন্ধুকে উপলব্ধি করতে পারে নাই। এই না পারার পেছনেও ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক কুরাজনীতির সংস্কৃতি বহুলাংশে দায়ী। জাতির পিতার অপমান যে সমগ্র জাতির অপমান, সেটি রাজনৈতিক আদর্শিক চর্চা দিয়ে সমষ্টির মাঝে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
নানান বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে জননেত্রী শেখ হাসিনার একক নেতৃত্ব ও প্রাজ্ঞতায় দেশ এগিয়ে চলছে। বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর সম্পূর্ণ অংশ দৃশ্যমান বিজয়ের মাসে বাঙালির আরেকটি বিজয় বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে বৈষম্য। এই বৈষম্য, অপরাজনীতি, আত্মকেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মায়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে উন্নয়ন অগ্রগতির চাকা এক সময় থেমে যাবে।
প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে সন্ত্রাস, উগ্রতা ও মৌলবাদ এক সময় আমাদের সব অর্জন ম্লান করে দেবে। দেশজুড়ে মৌলবাদীদের যে আস্ফালন তা শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আদর্শ দিয়ে অনাদর্শের কবর রচনা করার কৌশল নিতে হবে। পারস্পরিক সহমর্মিতা দিয়ে উগ্রতা দূর করতে হবে। বহুধাবিভক্ত শিক্ষার মাধ্যমে বিভাজিত নাগরিক সমাজ তৈরির আত্মঘাতি কৌশল যে কোন মূল্যে ঠেকিয়ে জাতীয়তাবোধের জাগরণ ঘটাতে হবে। সেটাই হোক বিজয়ের ৪৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আমাদের ধ্যান, জ্ঞান, রাজনীতি ও জীবনচর্চা কৌশল। তাহলে বাঙালির অগ্রগতি কোন অপশক্তি রুখতে পারবে না।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, আইডিইবি