আমীন আল রশীদ »
শৈশবের বন্ধু রিপন। থাকতো মালয়েশিয়ায়। করোনার মাসখানেক আগে দেশে এসেছিল পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে। যাওয়ার সময় হওয়ার আগেই করোনার হানা। মাসের পর মাস বসে আছে। কিছু টাকা জমা ছিল। ফলে এখন পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর মাস তিন-চারেক বসে থাকতে হলে তারপর কী খাবেÑতা নিয়ে দুশ্চিন্তা।
বিদেশ ফেরত এই মানুষগুলোর সবার পক্ষে রাতারাতি কৃষক বা মৎস্য খামারি হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার কৃষিতে চটজলদি ফল আসে না। করোনার সময় থেকে যারা দেশে আটকে আছেন, তারা সাত-আট মাস ধরে বেকার। টেনেটুনে হয়তো আরও মাস তিনেক চলতে পারবেন। কিন্তু তারপর? অনেকে এরইমধ্যে ভীষণ সংকটে পড়ে গেছেন।
ফিরে আসা প্রবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য দুইশ’ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আরও ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু গণমাধ্যমের খবর বলছে, সব শর্ত পূরণ করতে না পারায় ঋণ পাচ্ছেন না প্রবাসীরা। তাদের জন্য গঠিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে এখনও অর্থ ছাড় করাতে পারেনি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। সাড়ে তিন হাজারের বেশি প্রবাসী যোগাযোগ করলেও কেউ পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা জমা দেয়নি বলে দাবি করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ৪ শতাংশ সুদের এই প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ পাবেন চলতি বছরের মার্চ মাসের পর দেশে ফিরে আসা প্রবাসীরা। কিন্তু অনেকেই ঋণের জন্য আবেদন করলেও কত টাকা লাগবে, টাকা দিয়ে কী করবেন তা অনেকেই পরিষ্কার করে উল্লেখ করতে পারেননি। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে দেশে ফেরা প্রবাসীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। আয়ের কোনও উৎস নেই দেশে ফেরা ৮৭ শতাংশ প্রবাসীর। দেশে ফিরে সরকারি বা বেসরকারি কোনও সাহায্য পাননি ৯১ শতাংশ প্রবাসী। জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন ৫২ শতাংশ প্রবাসীর।
এদের মধ্যে অনেকেই করোনার কারণে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ ছুটিতে এসে আর যেতে পারেননি। অনেকে এসেছেন পারিবারিক প্রয়োজনে। অনেকে যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, সেখানে চাহিদা থাকলেও নানা জটিলতায় যেতে পারছেন না। ফলে দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন।
এর মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা জায়গা-জমি বিক্রি করে, জমি বন্ধক রেখে, মায়ের বিয়ের গহনা এমনকি হালের গরু বিক্রি করেও বিদেশে গিয়েছিলেন। হয়তো সেই দুঃসময় কেটেও গিয়েছিল। কিন্তু করোনা এসে তাদের অনেককেই আবার সেই দীনতার ভেতরে ছুঁড়ে ফেলছে। অভিবাসী কর্মীদের বেশিরভাগই চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। এখন কাজ নেই। অবৈধ ব্যক্তিরা কোনও কাজই পাচ্ছেন না। জীবন হয়েছে মানবেতর, অনেকেই দেশে ফেরার পথ খুঁজছেন। প্রবাসীকল্যাণ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তিনজন কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিক অদক্ষ। তারা নির্মাণ খাতেই কাজ করেন বেশি। অর্থনৈতিক চাপে ব্যয় সংকোচনের কারণে দেশগুলোতে এই খাতের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য খাতের শ্রমিকেরাও কাজ হারিয়েছেন।
করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও যেহেতু সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বা ছোট হয়ে গেছে, অনেক দেশেই কর্মী নেওয়ার হার অনেক কমে যেতে পারে।
তাহলে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখা ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের’ এই দুঃসময়ে রাষ্ট্রের কী করণীয় বা তাদের নিয়ে সমাজের মানুষের ভাবনা কী? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রথম আলো লিখেছে, ছাঁটাই করার আগে কর্মীদের অন্তত ছয় মাস সময় দিতে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু আরব দেশগুলো এতে সাড়া দিচ্ছে না। তাছাড়া কর্মীদের জায়গায় রেখে ব্যবসা বা অন্য কোনও কাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকার দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। তাতেও কোনও দেশ রাজি হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, কয়েক হাজার লোক ফিরলে আলাদা কথা, কিন্তু কয়েক লাখ ফিরলে বিরাট সমস্যা হবে। তাই সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার আবার তহবিল দেওয়ার প্রস্তাব করতে যাচ্ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
মনে রাখা দরকার, করোনা যেহেতু একটি বৈশ্বিক মহামারি, সুতরাং এরকম একটি দুর্যোগের মধ্যে বিদেশি কর্মীদের ফেরত পাঠানো প্রথম অনৈতিক, দ্বিতীয়ত আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। তাই সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে কর্মী পাঠানো অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলে সমঝোতার জন্য বিশ্ব পর্যায়ে চাপ তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে ফিরে আসা প্রবাসী এবং তাদের পরিবারের প্রতি যাতে কোনও ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা না হয়, সেদিকেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের নজর রাখা দরকার। সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, সেটি যাতে আগ্রহী প্রবাসীরা নির্বিঘেœ পেতে পারেন এবং শর্তের বেড়াজালে যাতে তাদের হয়রানি করা না হয়, সেদিকেও সরকারের শীর্ষ মহলের খেয়াল রাখা দরকার।
লেখক : সাংবাদিক