হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ তাআলার জন্য সকল প্রশংসা, যিনি শয়তানের প্ররোচনা হতে নিজ বান্দাদের সতর্ক করার জন্য যুগে যুগে পয়গম্বরগণকে এ ধরাধামে প্রেরণ করেছেন। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করি, যিনি পবিত্র কুরআনকে অপবিত্র ব্যক্তির জন্য স্পর্শ করা নিষিদ্ধ করেছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা, যিনি আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত বানিয়েছেন।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তাঁর প্রভুত্বে ও উপাসনায় কারো অংশীদারিত্ব নাই। তিনি লাÑশরীক, জরা, মৃত্যু, লয়, ক্ষয় ও যাবতীয় মুখাপেক্ষিতা হতে তিনি পবিত্র। আমাদের সঠিক পথদ্রষ্টা, প্রাণের মান্যবর হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র নিকটতম বান্দা ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসুল।
সর্বশেষ পয়গম্বর, প্রতিশ্রুত নবীর শুভ আবির্ভাবের পবিত্র স্মৃতিবহ মাহে রবিউল আউয়াল শরীফ বিদায়োন্মুখ। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, একটি মাত্র মাসের এ প্রহরগুলোতে যেভাবেই বলি না কেন, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের কথা শেষ করতে সক্ষম হবো না। তবে আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবহিত বলেই তাঁর হাবীবকে প্রশংসিত করার চিরন্তনী, কৌশলী প্রক্রিয়া প্রয়োগ করেছেন। যাতে সেই প্রিয়তম সৃষ্টি যেভাবে, সেখানেই উক্ত হবেন, তিনি প্রশংসিতই হবেন। খোদায়ী ব্যবস্থায়, তাঁর নাম নির্বাচিত হয়েছে ‘মুহাম্মদ’Ñ যার অর্থ চরম প্রশংসিত। তিনি সৃষ্টি হয়েছেন সবকিছুর আগে, মর্ত্যলোকে প্রেরিত হন সর্বশেষ নবী হিসাবে। হাশর ময়দানেও চর্চিত হবে তাঁর প্রশংসা, সর্বাদি মানব হযরত আদম (আ.) ও সৃজিত হওয়ার পর প্রথম চোখ মেলেই দেখতে পেয়েছিলেন সেই প্রশংসিত সৃষ্টির ‘মুহাম্মদ’ নাম। তিনি আদিতেও তিনি অন্তেও। তিনি এমন পবিত্র সৃষ্টি, শক্রও যাঁর ত্রুটি খুঁজে পায়নি। তিনি এমন অনিন্দ্যসুন্দর রূপ, দুর্মুখও যাঁর নিন্দার কিছু পায়নি। আল্লাহ্ তাআলা আমাদের প্রতি যারপরনাই অনুগ্রহ করেছেন। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল, তিনি আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত বানিয়েছেন। যিনি সমগ্র সৃষ্টির জন্য ‘রহমত’। যাঁর প্রতি অবতীর্ণ করেন পবিত্র কুরআন, যাতে মানব জাতির কল্যাণের সামগ্রিক নির্দেশনাই বর্ণিত কিয়ামত পর্যন্ত যে কিতাব মানসূখ বা রহিত হবে না। আমাদের কাছে সর্বশেষ এ নবী শুধু নিজেই সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, এতটুকু নন; বরং তাঁর কাছে আসা কিতাব ও সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব। তাঁর ওহী আনতেন যে ফেরেশতা, তিনিও হলেন ফেরেশতাকুল শ্রেষ্ঠ। নবীজির মু’জিযা’রও অন্ত নেই। তাঁর উম্মত ও পৃথিবীর সর্বোত্তম, শ্রেষ্ঠ উম্মত। যাঁদেরকে পবিত্র কুরআন ‘খাইরু উম্মত’ অভিধায় উল্লেখ করেছে। পবিত্র কুরআনের তেলাওয়াত যতদিন অব্যাহত থাকবে ততদিন এ উম্মতের প্রশংসাও চর্চিত হবে। ড. আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘আÑব্রূয়ে মা, যে নামে মুস্তফাÑস্ত্’। অর্থাৎ আমাদের মানÑমর্যাদা নবী মুস্তফার নামেই। সাহাবায়ে রাসূল’র শ্রেষ্ঠত্বের কারণ, তাঁরা নবীজির ফরমান বাস্তবায়নে জীবনপাত করতেও দ্বিধান্বিত হননি। নিবেদিতপ্রাণ তাঁর এ সহচরদের নিষ্ঠার দৃষ্টান্ত বর্ণিত হয়েছে তাওরাত এবং ইনজীল কিতাবেও (সুরা ফাৎহ্’র সর্বশেষ আয়াত দ্র.)
সঙ্গত কারণেই উম্মতের অন্তরে মাহে রবিউল আউয়াল ভিন্নÑমাত্রিক এক আবেদন জাগায়। তা হলো, আল্লাহ্ তাআলাÑযাঁকে সৃষ্টি করেই বাকি অযুত সৃষ্টিকানন রচনায় আগ্রহী হন, সেই ‘নূর ই মুহাম্মদী’ স্বমহিমায় প্রকাশ করে সৃষ্টিকুল শ্রেষ্ঠ মহিমায় মানবসভায় সমাসীন করার জন্য এ মাসেই তাঁকে এ মর্ত্যরে মাটিতে মানবাকৃতিতে প্রকাশিত করলেন। সৃষ্টিসুখের এ উল্লাসে অংশগ্রহণ করেছিল মানবদৃষ্টির অন্তরালেরও অনেক সৃষ্টিকুল। মানুষ তো এ আনন্দে হবে আরো বেশি ব্যস্ত, ব্যাকুল। কারণ, মানুষের সৃষ্টিব্যাপী শ্রেষ্ঠত্বের মূলে এ ইস্যুই কার্যকর যে, তাঁদের কাছেই, তাঁদের রূপেই, তাঁদের শেখাতেই, তাঁদের সমাজেই আল্লাহ্ তাআলা তাঁর প্রিয়তম সৃষ্টিকে পাঠালেন। আমরা কৃতজ্ঞ বিধাতার কাছে যে, ‘ধুলির ধরা বেহেশতে আজ, জয় করিল দিল রে লাজ’ সে ‘আজ’ অন্য কোন দিন নয়, এ রবিউল আউয়ালেরই বারো তারিখ। মহাকাল এ দিনটির দিকেই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে। কারণ ‘সৃষ্টির কারণ’ই আজ সৃষ্টির অপরূপ মডেল হয়ে জগৎসভায় প্রকাশিত রূপে হাসছে! সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিÑ নৈপুণ্য আজ অনন্যরূপে বরেণ্য, অপূর্ব!
কেউ যেন বলতে না পারে, প্রথম সৃষ্টি, আবার শেষ নবী হলো কীভাবে? কই এর আগে কোন মানুষ তো তাঁর নাম শোনেনি। তাই স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্ তাআলা প্রথম মানুষ সায়্যিদুনা আদম (আ.)’র সাথে এমনভাবে তাঁর পরিচয় ঘটিয়ে রেখেছেন, শুধু পরিচিতই নন আদমের কাছে অবিস্মরণীয়, বরং কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণীয় করে রেখেছেন। আদম (আ.)র তাওবা কবুল হওয়ার প্রসঙ্গে বিশ্ববরেণ্য তাফসীর গ্রন্থাদিতে এ তথ্য বিদ্যমান যে, আদম (আ.) সর্বপ্রথম বেহেশতে আর্শের পায়ায় আখেরী নবীর নাম খুদিত দেখেছিলেন। পরবর্তীতে দুনিয়ায় আসার পর আল্লাহ্র কাছে ইস্তিগফার করার এক পর্যায়ে তাঁর একথাটি মনে পড়ে। তখনই তিনি এ নামের ওয়াসীলা নিয়ে আল্লাহ্র কাছে দুআ করেন। তখনই তাঁর প্রার্থনা কবুল হয়। এ ঘটনা থেকে বুঝা যায় আদম (আ.) অস্তিত্ব লাভের পূর্বেও ‘মুহাম্মদ’ নাম ঊর্ধ্বজগতে লিপিবদ্ধভাবে সুসংরক্ষিত ছিল। তা ছিল নবীজির নূর-র পর্যায়। আমাদের নবী (দ.)র বহু বিশেষণসূচক নাম আছে, রাসূলেরও আসমায়ে হুসনা আছে। যেমনÑ ইয়াসীন, ত্বোয়াÑহা, মুদ্দাচ্ছির প্রভৃতি। মানবজাতির আদি পিতা আদম (আ.) সর্বপ্রথম ‘লাÑইলাহা ইল্লাল্লাÑহু মুহাম্মাদু রাসূলুল্লাহ্’ বাক্যটি দেখেন এবং পড়েনও। প্রজন্মের কাছে তাঁর মহিমা প্রচার করেন।
বহুকাল, বহু যুগÑযুগান্তর শেষে সেই তাওবায়ে আদম’র ওয়াসীলা, প্রথম সৃষ্টি নূরÑনবীজির প্রশংসিত সত্তা সেই ‘মুহাম্মাদ’ (দ.) মা আমেনার (রাদ্বি.) কোল আলো করে মানব জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। যিনি যুগে যুগে সব নবীর বড় বড় পরীক্ষা উত্তরণে শ্রেষ্ঠতম ‘ওয়াসীলা’ হয়ে তাঁদের সাথে বিধাতার, রহমত রূপে সম্পৃক্ত হন। এ জন্য তাঁর এক নাম ‘আউয়াল’ (সর্বপ্রথম), এক নাম ‘আখির’ (সর্বশেষ)ও। তিনি সর্বপ্রথম সৃষ্টি, তিনি সর্বশেষ নবী। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর কিতাব ও শরীয়ত’র বিধিÑবিধান বলবৎ থাকবে। প্রতিযুগে আগত পূর্ববর্তী নবীÑরাসূল সকলেই নিজ নিজ উম্মতের কাছে আমাদের শেষ নবীর গুণগান পূর্বক তার শুভ আগমনের কথা প্রচার করে গেছেন। তাঁর বৈশিষ্ট্যের কথাও বলে যান। কুরআনুল কারীমে সুরা সাফÑএ হযরত ঈসা (আ.)’র এ সম্পর্কিত উক্তিও উদ্ধৃত রয়েছে। পূর্বে বলা হয়েছে যে, সুরা ফাৎহ্-এ রাসুলুল্লাহর নিবেদিতপ্রাণ সহচরবৃন্দের কথা বর্ণিত হয়েছে। যেখানে শেষ নবীর সাহাবীর বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়, সেখানে যে আখেরী নবীজির কথা অনুক্ত রইবে, তা কী করে হতে পারে? এ ছাড়া সুরা আÑলে ইমরান’র ৮১তম আয়াতে আত্মার জগতে অনুষ্ঠিত নবীÑরাসূলগণের পবিত্র আত্মার মহতী শপথ অনুষ্ঠানের কথা বর্ণিত। সেখানে একমাত্র শপথের বিষয় ছিল, ‘আখেরী নবীর প্রতি সকলের ঈমান এবং তাঁর প্রতি সকলের একাত্মতা ও সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান’।
তাঁরা সকলে নিজ নিজ উম্মতের কাছে আখেরী নবীর পৃথিবীতে আগমনী বারতা নবুওয়তের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিবেচনায় গুরুত্ব সহকারে প্রচার করেছেন। এ প্রসঙ্গে সুরা সাফÑএ হযরত ঈসা (আ.) র প্রচার প্রসঙ্গ আগেই উল্লেখ হয়েছে। এখানে পরিসর স্বল্পতা বিবেচনায় পবিত্র কুরআনের বিশেষ একটি আয়াতের তর্জমা উপস্থাপন করা হল প্রিয় পাঠকের খেদমতে, যা তাওরাতÑইনজীলÑএ বর্ণিত আখেরী নবীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত। এতে আজকের বিষয়বস্তু আস্বাদন করা যাবে। মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘অনতিবিলম্বে আমি আমার (আখেরাতের বিশেষ) নে’মাতসমূহ তাঁদের জন্যই লিখে দেবো, যারা (অন্তরে) তাকওয়া (খোদাভীতি) ধারণ করে, যাকাত দেয় এবং যাঁরা আমার নিদর্শনসমূহে ঈমান আনে। যে সব লোক উম্মী নবী, রাসূলের দাসত্ব করবে, যারা তাঁকে নিজেদের কাছে তাওরাত ও ইনজীলে লিপিবদ্ধরূপে পায়, যিনি তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেবেন ও অসৎকাজ হতে বাধা দেবেন, তাদের জন্য পবিত্র বস্তুরাজি হালাল সাব্যস্ত করেন, আর অপবিত্র বস্তুগুলো তাদের ওপর হারাম স্থির করবেন। আর তাদের ওপর থেকে কষ্টের বোঝা ও গলার শৃঙ্খলগুলো যা তাদের ওপর ছিল, তিনি অপসারিত করে দেবেন। অতএব, যারা তাঁর ওপর ঈমান আনে ও তাঁকে যথোচিত সমীহ করে, তাঁকে সর্বতো সাহায্য করে এবং তাঁর সাথে যে নূর (আল্কিতাব) অবতীর্ণ হয়েছে, সেটার নির্দেশনা যথার্থ অনুসরণ করে, তাঁরাই তো সফলকাম।’ (সুরা আ’রাফ: আয়াত-১৫৭)
এখানে যে বিষয়সমূহ উক্ত হয়েছে, সংক্ষেপে তা হলোÑ আখেরাতের নেয়ামত পেতে হলে চাই, তাকওয়া, যাকাত প্রদান, আল্লাহ্র নিদর্শনে বিশ্বাস। ‘নবী’ ‘রাসূল’ও ‘উম্মী’ প্রিয় হুযূর (দ.)র বিশেষণ। নবী হলেন অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদদাতা, রাসূল যাঁর ওপর কিতাব অবতীর্ণ হয়। উম্মী’র অর্থ মৌলিক নবী, আসল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও যিনি সৃষ্টি ও ¯্রষ্টার সঠিক জ্ঞান পূর্ণভাবে প্রাপ্ত হন। নবী হালালÑহারাম করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তাঁর আগমন সংবাদ পূর্বের নবী রাসুলগণ নিজ নিজ কিতাবসমূহে প্রাপ্ত হয়েছেন এবং উম্মতদের কাছে বর্ণনা করেছেন। পূর্ব চর্চিত যাঁর প্রশস্তি।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব :হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।