সুপ্রভাত ডেস্ক »
ডেঙ্গু রোগের চারটি পর্যায়ের মধ্যে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে ‘শক সিনড্রোমে’। সাধারণত দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে শক সিনড্রোমে চলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বেশি। কিন্তু চট্টগ্রামে অধিকাংশ রোগীই প্রথমবার আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় শক সিনড্রোমে চলে যাচ্ছেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, এসব রোগীরা হয়ত আগেও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন কিন্তু লক্ষণ প্রকাশ হয়নি অথবা ডেঙ্গুর আরও জটিল কোনো ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছেন তারা।
এ অবস্থায় করোনা পরীক্ষার মতো পিসিআর পদ্ধতি ব্যবহার করে ডেঙ্গুর ধরন চিহ্নিত করলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। খবর সারাবাংলা’র।
ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে আছে, উপসর্গবিহীন ডেঙ্গু, উপসর্গ দৃশ্যমান অর্থাৎ ডেঙ্গু ফিভার, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং এক্সপান্ডেড শক সিনড্রোম বা ডেঙ্গু হেমারোজিক। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও এক্সপান্ডেড শক সিনড্রোম বা ডেঙ্গু হেমারোজিক হল আক্রান্ত রোগীর ‘ক্রিটিক্যাল পর্যায়’, যা চট্টগ্রামে এবার বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর চট্টগ্রামে মোট ৭ হাজার ৩৫১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৬৩ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, মৃত ৬৩ জনের মধ্যে ৩৭ জনই শক সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন। অর্থাৎ ৫৮ শতাংশ রোগীই প্রাণঘাতী শক সিনড্রোমের শিকার। এর মধ্যে, ১৪ জন ডেঙ্গু শক সিনড্রোম, ২৩ জন এক্সপান্ডেড শক সিনড্রোম বা জটিল হেমারোজিকে মারা গেছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের উপসর্গ হলো শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া। ত্বক শীতল হয়ে যাওয়া। ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের ওপর লাল ছোপ সৃষ্টি হওয়া। বমি, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচ- পেটব্যথা ও অনবরত বমি হওয়া, নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ও অবসাদ। কখনও মস্তিষ্কের ভেতর রক্তক্ষরণ হতে পারে।
আর রোগী এক্সপান্ডেড শক সিনড্রোম বা হেমারেজিকের পর্যায়ে চলে গেলে শরীরের যে কোনো জায়গা থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়। এর ফলে আস্তে আস্তে কিডনি, লিভার, ব্রেন ও হার্টসহ শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল ইনফেকশাস ডিজিজেস’র (বিআইটিআইডি) সহযোগী অধ্যাপক মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর যখন প্লাজমা লিকেজ হতে শুরু করে, তখন রোগীর রক্তচাপ কমে যায় এবং শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হয়। এটা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এর থেকেও জটিল পর্যায় হল এক্সপান্ডেড শক সিনড্রোম বা আর হেমারোজিক, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ। রোগী শক সিনড্রোমে চলে গেলে ভালো হতে সময় লাগে।’
‘যারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়, তারাই সাধারণত শকে চলে যায়। এবার শক সিনড্রোমে আক্রান্তের হার বেশি এবং মৃত্যুও বেশি হচ্ছে। আমরা নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এবার ৩০ শতাংশ রোগীই শক সিনড্রোমে বা এক্সপান্ডেড শক সিনড্রোমে আক্রান্ত। তবে ৭০ শতাংশ রোগী শুধুমাত্র জ্বর ও শরীর ব্যাথায় আক্রান্ত। তারা কয়েকদিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যাচ্ছে।’
গত ২৩ আগস্ট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তৃষ্ণা রাণী রায় (৩৯) নামে এক নারী চট্টগ্রামের বেসরকারি একটি হাসপাতালে মারা যান। তিনি ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন। মাত্র চারদিনের জ্বরের মধ্যেই হঠাৎ শ্বাসকষ্টে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখানো হয়, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও মাল্টিঅর্গান ফেইলিয়র।
তৃষ্ণা রাণী রায়ের ছেলে রুদ্র রায় বলেন, ‘জ্বর আসার পর মায়ের শরীর হালকা ব্যথা ছিল। দুদিন পর মা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। এর পরদিন হঠাৎ করে মায়ের শ্বাসকষ্ট ওঠে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার আমাদের রক্ত ম্যানেজ করতে বলে। কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার জানান, মায়ের হার্ট ও লিভার কাজ করছে না। তিনি মারা গেছেন।’
একইভাবে গত ১৮ আগস্ট ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে’ আক্রান্ত হয়ে মারা যান রাজলক্ষী শর্মা (৫৯) নামে এক নারী। ছেলে কুলদীপ শর্মা বলেন, ‘মায়ের আগে থেকেই থাইরয়ডের সমস্যা ছিল। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর বিআইটিআইডিতে ভর্তি করি। অবস্থা ক্রিটিক্যাল দেখে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি। সেখানেই তিনি মারা যান।’
জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটি, চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণত দ্বিতীয়বার আক্রান্ত রোগীর ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে চলে যাবার ঝুঁকি বেশি। তার মানে এই নয় যে, প্রথমবার আক্রান্ত হলে কেউ শক সিনড্রোমে যাবে না। সেক্ষেত্রে তিনি ডেঙ্গুর যে পর্যায় কিংবা যে ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন সেটার বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। এ জন্য আমরা বলছি, পিসিআর টেস্টের দিকে নজর দিতে হবে। এটা সহজলভ্য করতে হবে। শুধুমাত্র ডেঙ্গু পজেটিভ আর নিগেটিভ নির্ণয় না করে ধরন শনাক্ত করতে হবে। তাহলে মৃত্যুহার ঠেকানো সম্ভব হবে।’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর চট্টগ্রামে মোট ৭ হাজার ৩৫১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩৭৯ জন পুরুষ, ২ হাজার ৭১ জন নারী এবং ১ হাজার ৯০১ জন শিশু এবং কিশোর। চলতি সেপ্টেম্বরের গত ১২ দিনে এক হাজার ৫৬৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এর আগে, আগস্টে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তিন হাজার ১১ জন। এছাড়া জানুয়ারিতে ৭৭ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২২ জন, মার্চে ১২ জন, এপ্রিলে ১৮ জন, মে’তে ৫৩ জন, জুনে ২৮৩ জন এবং জুলাইয়ে ২ হাজার ৩১১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের কীটকূশলী সৈয়দ মো. মঈন উদ্দীন বলেন, ‘এবারে বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগী দ্রুততার সাথে শক সিনড্রোমে চলে যাচ্ছে। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের শক সিনড্রোমের ঝুঁকি বেশি দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত অনেক রোগীই একদম শেষপর্যায়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়ায় অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে।’
আক্রান্তে পুরুষ এবং মৃত্যুতে নারী-শিশু এগিয়ে
চলতি বছর ডেঙ্গুতে পুরুষ বেশি আক্রান্ত হলেও নারী ও শিশুর মৃত্যুহার বেশি। সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের ৪৬ শতাংশ পুরুষ, ২৮ শতাংশ নারী এবং ২৫ শতাংশ শিশু। অন্যদিকে মোট মৃত্যুর ৭৪ শতাংশই নারী ও শিশু এবং পুরুষ ২৬ শতাংশ। চট্টগ্রামে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৬৩ জনের মধ্যে ২৩ জন শিশু, ২৪ জন নারী ও ১৬ পুরুষ।
ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট (ড্যান) চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. চন্দন দাশ বলেন, ‘শক সিনড্রোমে শরীরের রক্ত সঞ্চালন কমে গিয়ে ইফেক্ট পড়ছে লিভার, হার্ট এবং মস্তিষ্কে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই পর্যায়ের বড় শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা। সে জন্য আমরা বলছি, ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশের পর যেন দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হয়।’
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদৌস বলেন, ‘আমাদের দেশে নারীরা বেশি পরিশ্রম করে আর পুষ্টিগত খাবার কম খায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নারীদের শরীরে কম। শিশুদের ইমিউনিটির অবস্থাও একই। এ জন্য ডেঙ্গু আক্রান্ত নারী-শিশু মারা যাচ্ছে বেশি।’
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে চট্টগ্রামে ১৭ জন, ২০২১ সালে ২৭১ জন এবং ২০২২ সালে পাঁচ হাজার ৪৪৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। ২০২২ সালে ৪১ জন এবং ২০২১ সালে পাঁচজন মারা গিয়েছিল।