চমেক হাসপাতাল
নিলা চাকমা
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় চমেক হাসপাতালে ৫০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ড ও ১০ শয্যার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের প্রস্তাবনা থাকলেও তা থেকে সরে এসেছে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এডিবিরি প্রস্তাবনাকে পাশ কাটিয়ে হাসপাতালে বর্তমানে ৪০ শয্যার আইসিইউ করার পরিকল্পনা নিয়েছে চমেক হাসপাতাল। আর এতে দ্বিমত প্রকাশ করেছে হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা।
জানা যায়, কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমার্জেন্সি অ্যাসিস্টেন্ট প্রজেক্ট’ এ প্রকল্পের আওতায় চমেকে ৫০ শয্যার ‘আইসোলেশন’ এবং ১০ শয্যা আইসিইউ করার নির্র্দেশনা ছিলো। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের ১৭টি হাসপাতাল এ প্রস্তাবনা পায়। এ প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-১ এ ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর চমেক হাসপাতালে জায়গা বাছাই করার জন্য চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে প্রাক্তন চমেক হাসপাতাল পরিচালক এস এম হূমায়ুন কবীর, উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম, চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী রাহুল গুহ, চমেক হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক রাজিব পালিতসহ অনেকে স্বাক্ষর করেন। চিঠিতে বলা হয়- পিসিআর ল্যাবসহ ৫০ শয্যার ‘আইসোলেশন’ এবং ১০ শয্যা আইসিইউ করা হবে। তার জন্য ৬০০০ বর্গফুটের অধিক জায়গা নির্বাচনের নির্দেশনা ছিলো।
পরে হাসপাতালের নিচে মনোরোগ বিভাগে ‘আইসোলেশন’ ওয়ার্ড করার জন্য জায়গা নির্বাচন করা হয়। চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝিতে মনোরোগ বিভাগকে দোতলায় স্থানান্তর করা হয়। পরে ১৯ মে থেকে সেখানে এডিবি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকা। আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে কাজ শেষ হবে বলে জানা গেছে। নামে ‘আইসোলেশন’ ওয়ার্ড হলেও পরে এটিকে আইসিউইতে রূপান্তর করা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে ৪০ শয্যার আইসিইউ করা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের চিকিৎসকেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিসিন ওয়ার্ডের এক চিকিৎসক বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। করোনার মতো আরও মরণঘাতী ভাইরাস আসতে পারে যেকোনো সময়। করোনার সময় কোনো ‘আইসোলেশন’ ওয়ার্ড না থাকায় পুরো হাসপাতালের চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটে। কয়েকটি ওয়ার্ডে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এখন ‘আইসোলেশন’ ওয়ার্ডের দরকার পড়ছে না। কিন্ত তার পরিবর্তে সংক্রামক রোগীদের চিকিৎসা দিতে হবে। বছরের একেক সময় জলাতংক, গুটি বসন্ত রোগীদের সংখ্যা বাড়ে। এ রোগগুলোর আলাদা কোনো ওয়ার্ড না থাকায় সাধারণ রোগীদের সঙ্গে সেবা দেওয়া হয়। এতে অন্য রোগীদের মাঝেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
‘আইসোলেশন’ ওয়ার্ড রাখার দাবিতে তিনি আরও বলেন, আইসিইউ হাসপাতালের যেকোনো জায়গায় করা যাবে। কিন্ত আইসোলেসন করা যাবে না। কেননা জায়গাটি বিশেষভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। তাছাড়া এডিবি থেকে বলা হয়েছে শুধু মাত্র ‘আইসোলেশন’ ওয়ার্ডের জন্য এ প্রকল্প। শুধু ভাইরাসজনিত রোগ নয়, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু রোগীও বাড়ে একেক সময়। ২০১৯ সালে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডকে পুরো ডেঙ্গু ওয়ার্ড বানানো হয়েছিলো। এতে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। অফিসের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রায় সব ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্ত মেডিসিন ওয়ার্ডে রোগী ভর্তির জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়। যার কারণে ক্যান্সার, নেপ্রোলোজি, কিডনি রোগীসহ বিভিন্ন রোগীদের মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হয়। যেহেতু জনবলের অভাব নেই, সেহেতু জায়গা পেলে চিকিৎসা সেবা আরও প্রসারিত হবে। রোগীরা চিকিৎসা সেবা পাবেন। তিনি মেডিসিন ওয়ার্ডের জায়গায় আইসিইউ না করার দাবি জানান।
সূত্রে জানা যায়, চমেক হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডে ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৬৭ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তার মধ্যে ৩ জন মারা যান। ২০২২ সালে ১ হাজার ৭৫৭ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। সে বছর মারা যান ২৩ জন। ডায়রিয়াতে ২০২২ সালে ৩ হাজার ৭৯১ জন চিকিৎসা নেন। তারমধ্যে ৭ জন মারা যান। এছাড়া ম্যালেরিয়াতে ২০২১ সালে ৬৩ জন এবং ২০২২ সালে তা বেড়ে ২৬৩ জন চিকিৎসা নেয়। এ ওয়ার্ডের ৩৩টি ফ্যাকাল্টি রয়েছে। ১৯২ শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০- ৪০০ জন রোগী ভর্তি থাকে।
বাড়তি রোগীর চাপ প্রসঙ্গে মেডিসিন ওয়ার্ডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও এক চিকিৎসক বলেন, ‘প্রায় সকল ওয়ার্ডের রোগী এখানে ভর্তি থাকে। জায়গার তুলনায় রোগীর চাপ বেশি। এরপর মৌসুমী বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হন সাধারণ রোগীরা। মেডিসিন ওয়ার্ডের জন্য আসা এডিবির প্রকল্প কেন আইসিইউ হবে। অনেক মৌসুমী রোগী এখানে না রাখতে পেরে বিআইটিআইডিতে পাঠাতে হয়। এতে রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এডিবির প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মেডিসিন ওয়ার্ডের স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত হবে। রোগীদের আর বিআইটিআইডিতে যেতে হবে না। ’
এ দিকে সরেজমিনে (৩ মে) বুধবার সকালে দেখা যায় নিচের পুরোনো মনোরোগ বিভাগে ভেতরের সব দেওয়াল ভাঙা হয়েছে।সেখানে পেছনের একটি দেওয়াল পুরু করে গেট বানানো হয়েছে।
কাজের অগ্রগতি নিয়ে প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, ‘ঈদের কয়েকদিন আগে কাজ শুরু হয়। পরে ২ মে থেকে কাজ আবার শুরু হয়েছে। এখনো কাজের তেমন অগ্রগতি হয়নি। তবে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে দিকে কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রকল্পের ব্যয় সাড়ে তিন কোটি টাকা। কিন্ত কন্ট্রাক্ট পেয়েছি মাত্র ২ কোটি ৭২ লাখের মতো। ’
‘আইসোলেশন’ ওয়ার্ড’ না ‘আইসিইউ’ এর কাজ চলছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আামদের প্রজেক্ট হলো ৫০ শয্যার ‘আইসোলেশন’ ওয়ার্ড’ এবং ১০ শয্যার ‘আইসিইউ’ করা। আমরা তা করে শেষ করে দিব। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এটা আইসিইউ না আইসোলেশন ওয়ার্ড বানাবে সেটা তাদের সিদ্ধান্ত।’
এ প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, এটা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়নে ৫০ শয্যার আইশোলেসন এবং আরও ১০ শয্যার আইসিইউ থাকবে। বাইরে আইসোলেসন ওয়ার্ড হলেও ভেতরে ৩০-৪০ ওয়ার্ডের আইসিইউ শয্যা বানানোর পরিকল্পনা আছে। ওই ডিজাইনে কাজ চলমান রয়েছে। যেহেতু চমেক হাসপাতালের আইসিইউ সংকট রয়েছে। এতে রোগীদেরই লাভ।