সুপ্রভাত ডেস্ক »
আউট হয়ে তখন আস্তে আস্তে ড্রেসিং রুমের দিকে হাঁটছিলের সাকিব আল হাসান। গ্যালারিতে দেখা গেল তাড়া, দল বেঁধে মাঠ ছাড়ছিলেন অনেক দর্শক। ছুটির দিনে মাঠ ছিল দর্শকে ঠাসা। তাদের অর্ধেকের বেশিই মাঠ ছেড়ে গেলেন যখন, ম্যাচের বাকি তখনও ২০ ওভারের বেশি! এই খন্ডচিত্রেই প্রমাণ, কতটা একতরফা ছিল ম্যাচ। বাংলাদেশ পারল না ন্যূনতম লড়াই করতেও।
সিরিজ জিইয়ে রাখতে প্রয়োজন ছিল জয়। কিন্তু এদিন বাংলাদেশের বোলিং-ফিল্ডিং-ব্যাটিং, সব কিছুই বাজে হলো একসঙ্গে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে শুক্রবার ১৩২ রানের জয়ে ইংল্যান্ড জিতে গেল সিরিজও।
২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের কাছেই দেশের মাঠে ওয়ানডে সিরিজ হেরেছিল বাংলাদেশ। এরপর প্রায় ৭ বছরে টানা ৭ সিরিজ জিতে আবার হারতে হলো সেই ইংলিশদের কাছেই।
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের শততম ওয়ানডে ছিল এটি। তিন সংস্করণ মিলিয়ে এই মাঠের ছিল ২০০তম ম্যাচ। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ পারেনি ২০০ রানও করতে। ব্যাটিংয়ের আগে বোলিংও ছিল যাচ্ছেতাই।
টস জিতে বোলিং নিয়ে বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল বলেন, ‘উইকেট একটু নরম ও চিটচিটে।’ টস হেরেও জস বাটলারের মুখে ছিল হাসি। তিনি যে আগে ব্যাটিংই চেয়েছিলেন! ইনিংস শেষে প্রমাণ হয় ইংলিশ অধিনায়কই পিচ পড়তে পেরেছিলেন ভালো। ৫০ ওভারে ইংল্যান্ড তোলে ৩২৬ রান।
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে ৫ বছর আর ১৫ ম্যাচ পর প্রথমবার কোনো দল ছুঁতে পারে তিনশ রান। এর চেয়ে বড় স্কোর সবশেষ ছিল ২০১৫ সালের এপ্রিলে, যখন পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩২৯ করেছিল বাংলাদেশ।
ইংল্যান্ডের বড় স্কোরের ভিত গড়া হয় জেসন রয়ের ব্যাটে। আগের ম্যাচে ব্যর্থ ওপেনার এবার ১৮ চার ও ১ ছক্কায় খেলেন ১২৪ বলে ১৩২ রানের ইনিংস। বাটলারের ব্যাট থেকে আসে ৬৪ বলে ৭৬।
মইন আলি সাতে নেমে করেন ৩৫ বলে ৪২, স্যাম কারান অপরাজিত থাকেন ১৯ বলে ৩৩ রানে।
বাংলাদেশের বোলিং ছিল একদমই ধারহীন। আরও বাজে ছিল গ্রাউন্ড ফিল্ডিং। বাড়তি এক-দুই রান তো বটেই, আলগা ফিল্ডিংয়ে বাউন্ডারিও আসে কয়েকটি।
জিততে হলে রান তাড়ায় নিজেদের আগের রেকর্ড ছাড়াতে হতো বাংলাদেশকে। কিন্তু প্রথম ওভারে দুই উইকেট হারানো দল কোনো লড়াই করতেও পারেনি। গুটিয়ে যায় তারা ১৯৪ রানে।
ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের শুরুটাই ছিল আত্মবিশ্বাসী। নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে মাত্র পঞ্চমবার দুই প্রান্তে স্পিন দিয়ে আক্রমণ শুরু করে বাংলাদেশ। প্রথম ওভারে সাকিব আল হাসানকে দারুণ শটে চার মারেন ফিল সল্ট, পরের ওভারের প্রথম বলেই তাইজুল ইসলামকে বাউন্ডারিতে পাঠান রয়।
জোড়া স্পিন কার্যকর হয়নি, বাংলাদেশ প্রথম ব্রেক থ্রু পায় পেসে। তাসকিনের বলে স্লিপে সল্টের (৭) ক্যাচ নেন নাজমুল হোসেন শান্ত।
এরপর কেবলই যেন রয়-শো। আগের ম্যাচের নায়ক দাভিদ মালান ভুগতে থাকেন থিতু হতে। কিন্তু রয়ের ব্যাট ছুটতে থাকে দারুণ গতিতে। বাড়তে থাকে রান।
১৫ ওভার শেষে মেহেদী হাসান মিরাজ আক্রমণে এসেই ভাঙেন এই জুটি। ফ্লাইট-ড্রিফট-টার্ন মিলিয়ে দুর্দান্ত ডেলিভারিতে মালানকে বিভ্রান্ত করেন মিরাজ। জুটিতে আসে ৫৪ বলে ৫৮ রান, তাতে মালানের অবদান স্রেফ ১৯ বলে ১১!
রয় ফিফটি করেন ৫৪ বলে। এরপর তার ব্যাটের ধার বেড়ে যায় আরও। জেমস ভিন্সকে দ্রুত ফেরান তাইজুল। কিন্তু রয় ও বাটলারের জুটিতে ইংল্যান্ড এগোতে থাকে বাংলাদেশকে হতাশ করে। দুজনের কেউ তেমন একটা সুযোগই দেননি।
স্পিনারদের লেংথ এলোমেলো করতে রিভার্স সুইপের পথ বেছে নেন দুজনই। তা কাজেও লাগান দারুণভাবে। ৭টি রিভার্স সুইপ খেলে রয় বাউন্ডারি আদায় করেন ৪টিতেই।
রয় তিন অঙ্কে পা রাখেন ১০৪ বলে। ওয়ানডেতে দ্বাদশ সেঞ্চুরিতে স্পর্শ করেন তিনি মার্কাস ট্রেসকোথিককে। ইংল্যান্ডের হয়ে তার চেয়ে বেশি ওয়ানডে সেঞ্চুরি আছে আর কেবল ওয়েন মর্গ্যান (১৩) ও জো রুটের (১৬)।
সেঞ্চুরির পর রয়ের ব্যাট হয়ে ওঠে উত্তাল। মুস্তাফিজের ওভারে দুটি চার মারেন তিনি, সাকিবের ওভারেও দুটি, তাসকিনের ওভারে তিনটি।
ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা ব্যাটসম্যানকে শেষ পর্যন্ত থামান সাকিব। আর্ম ডেলিভারিতে সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হন রয়। ১৩২ রান করেও তাকে বিরক্ত দেখা যায় নিজের এই শটে। হতাশায় ব্যাট ছুঁড়ে দেন বাতাসে।
পরের ওভারে উইল জ্যাকসকে ফিরিয়ে রাশ টেনে ধরার ইঙ্গিত দেন তাসকিন। কিন্তু বাটলার যে ততক্ষণে লাগাম ধরে ফেলেছেন!
শুরুতে এক-দুই রান নিয়ে থিতু হন ইংলিশ অধিনায়ক। এরপর খেলতে থাকেন স্বচ্ছন্দে। ফিফটি পূরণ করেন তিনি ৫০ বলে।
মইন আলিও ক্রিজে গিয়ে খেলতে থাকেন শট। গড়ে ওঠে আরেকটি দ্রুতগতির অর্ধশত রানেন জুটি।
মিরাজকে বিশাল দুটি ছক্কা মারার পর বাটলারের ইনিংস শেষ হয় তাকেই ফিরতি ক্যাচ দিয়ে। তুমুল গতিতে আসা বলটি দুর্দান্ত রিফ্লেক্সে মুঠোয় জমান এই অফ স্পিনার।
তবে ইংলিশদের আক্রমণ থেকে নিস্তার মেলেনি বাংলাদেশের। মিরাজের ওভারে বিশাল দুটি ছক্কা মারেন মইন। কারান উইকেটে যাওয়ার পরপরই দুর্দান্ত এক শটে সীমানা ছাড়া করেন মুস্তাফিজকে।
মইন বিদায় নিলেও কারানের ঝড় চলতেই থাকে। শেষ ওভারে তিনি টানা দুটি ছক্কায় ওড়ান তাসকিনকে। শেষ ১০ ওভারে ইংল্যান্ড তোলে ১০৭ রান।
বাংলাদেশে ১৩ ওয়ানডে খেলে নিজেদের আগের সর্বোচ্চ ৩০৯ ছাড়িয়ে ইংল্যান্ড করে এবার ৩২৬।
নিয়মিত ৫ বোলার ছাড়া আর কাউকে ব্যবহার করেননি বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ভালো বোলিং করতে পারেননি কেউই। তাসকিন শুরুটা ভালো করলেও পরে খেই হারান। মুস্তাফিজুর রহমান আরও একবার ছিলেন বিবর্ণ।
বাংলাদেশের রান তাড়া টালমাটাল হয়ে পড়ে প্রথম ওভারেই। ইনিংসের চতুর্থ বলেই কারানকে আলগা ড্রাইভে পয়েন্টে ক্যাচ দেন লিটন কুমার দাস। পরের বলেই কারানের সুইংয়ে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন নাজমুল হোসেন শান্ত।
ওয়ানডেতে লিটনের তৃতীয় ‘গোল্ডেন ডাক’ এটি। শান্ত শূন্যতে ফিরলেন তিনবার। তিনটিই ‘ ‘গোল্ডেন ডাক!’
কারানের পরের ওভারে বিদায় নেন মুশফিকুর রহিমও। টানা ৭ ওয়ানডে ইনিংসে তিনি পার হতে পারলেন না ২৫। দলের রান তখন ৩ উইকেটে ৯।
এরপর তামিম ও সাকিব মিলে চেষ্টা করেন ইনিংস মেরামতের। নিজেদের পঞ্চাশতম জুটিতে পঞ্চাশও পেরিয়ে যান তারা। কিন্তু বল একটু বেশিই লেগে যায় তাতে। বিশেষ করে তামিমের।
যদিও তার শুরুটা ছিল সাবলিল। এক পর্যায়ে চারটি চারে ৩১ বলে তার রান ছিল ২৩। তবে এরপরই একদম ঝিমিয়ে যান। পরের ৩৪ বলে করতে পারেন কেবল ১২ রান!
শেষ পর্যন্ত শেকল ভাঙার চেষ্টায় বাংলাদেশ অধিনায়কের যন্ত্রণাময় উপস্থিতি থামে মইনকে উইকেট উপহার দিয়ে। জুটি শেষ হয় ১১১ বলে ৭৯ রানে।
সাকিব অবশ্য ধীরে শুরু করলেও পরে ঠিকই পুষিয়ে দেন। তবে ৫১তম ওয়ানডে ফিফটিকে বড় করতে পারেননি তিনিও। আদিল রশিদের বলে জায়গা বানিয়ে খেলতে গিয়ে কাটা পড়েন তিনি ৬৯ বলে ৫৮ করে।
ম্যাচের উত্তেজনা ততক্ষণে শেষ। বাকি ছিল কেবল ব্যক্তিগত কিছু প্রাপ্তি। সেখানেও খুব সফল হননি বাকিরা। মাহমুদউল্লাহ ৪৯ বল খেলে করতে পারেন ৩২। আফিফ ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েও আউট হয়ে যান ৩৩ বলে ২৩ করে। ব্যর্থ হন মিরাজও (১৪ বলে ৭)।
এরপর মাঠে থাকা দর্শকদের কিছুটা বিনোদন দিয়ে চার বাউন্ডারিতে ২১ রান করে রান আউট হন তাসকিন। দলের ইনিংস শেষ হয় ৩২ বল আগেই।
ব্যাটিংয়ে ক্যামিওর পর বল হাতে কারানের শিকার ৪টি। আদিল রশিদের লেগ স্পিনেও ধরা দেয় ৪ উইকেট।
২০১৬ সালের সিরিজে বাংলাদেশ হেরেছিল শেষ ম্যাচে গিয়ে। এবার শেষ ম্যাচের আগেই শেষ সিরিজের উত্তেজনা। বিশ্বকাপের বছরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে এমন পারফরম্যান্স দলের জন্য হয়তো জেগে ওঠার ডাকও।