সুপ্রভাত ডেস্ক »
বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত রয়েছে কক্সবাজারে, অপরদিকে বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণির হাতছানি- কক্সবাজারকে শহরকে করে তুলেছে দেশের শীর্ষ পর্যটন নগরী। তবে এই নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, হোটেল-রিসোর্টের চাকচিক্যের আড়ালে– লুকিয়ে আছে ভিন্ন এক বাস্তবতা, মধুচন্দ্রিমা উদযাপনে আসা দম্পতিদের সমুদ্র তীরের নিরাপদ পর্যটন কেন্দ্র না হয়ে- অপরাধের নগরী হয়ে উঠেছে কক্সবাজার। নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবা প্রবেশের গেটওয়ে কক্সবাজার এখন দেশের ‘অপরাধের রাজধানী’ হিসেবেও কুখ্যাতি অর্জন করেছে।
দক্ষিণের জেলা কক্সবাজার এখন ইয়াবা পাচারকারী চক্রগুলির নিরাপদ স্বর্গ। মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে হত্যাকা- ঘটছে প্রতিনিয়ত। মানবপাচার ব্যবসাও উঠেছে ফুলেফেঁপে– এই পাচারকারীরা নৌকাবোঝাই করে গভীর সাগর পাড়ি দিতে পাঠাচ্ছে হতভাগ্য মানুষদের, যাদের অনেকেই হয়তো আর কোনোদিন এই বিপজ্জনক যাত্রা থেকে বেঁচে ফিরবে না।
সবচেয়ে গুরুতর অবশ্য মাদক ব্যবসা। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তরের তথ্যমতে, ২০২১ সালে দক্ষিণপূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় প্রথমবারের মতো- মোট ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের মেথামফেটিন ট্যাবলেট বাজেয়াপ্ত করার রেকর্ড হয়েছে। ১০ বছর আগের তুলনায় যাত সাতগুণ বেশি।
২০১৮ সালে মাদকবিরোধী অভিযানকালে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই ১ কোটি ২৮ লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই অভিযানের সময় এক লাখের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ৫১৯ জন।
এই বছরের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযানে ৩৮ লাখ পিস মেথামফেটিন বা মেথ ট্যাবলেট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু, এই জব্দ করা ট্যাবলেটের পরিমাণ আসল বাণিজ্যের হিমশৈলের চূড়ামাত্র। অর্থাৎ, যত ট্যাবলেট পাচার হয়ে আসছে তার সামান্য পরিমাণ চালানই ধরা পড়ছে বলে জানান আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্টরা।
মাদকটির এই অবাধ বিস্তার বিপুল অঙ্কের হয়ে ওঠায়– ২০১৬ সালে সরকারি কর্মকর্তারা বলেছিলেন, এ বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ৩০০ কোটি ডলারে বেশি। তবে দেশে ইয়াবা বাণিজ্যের বর্তমান পরিমাণ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বা নির্ভরযোগ্য কোনো উৎসের হিসাব নেই।
মাদক ব্যবসার বিপুল টাকায় প্রভাব বিস্তার করে মাদক ব্যবসায়ীরা, কেনে অস্ত্র। এমনকী অর্থের বিনিময়ে তারা শাস্তি থেকে অব্যাহতিও পাচ্ছে।
কক্সবাজার জেলার আইনশৃঙ্খলার সাথে জড়িত একজন নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, তামিল সিনেমায় দুই পরিবার বা গোষ্ঠীর মধ্যে বংশ পরম্পরায় চলে আসা বিরোধ দেখা যায়। দিনেদুপুরে মানুষ নৃশংসভাবে খুন হয়। এখানে আসার পরে ঘটনা দেখলাম সত্য।
তিনি আরও বলেন, এখানে লবণ মাঠ নিয়ে, জায়গাজমি নিয়ে, এলাকায় প্রাধান্য ধরে রাখা নিয়ে খুনজখমের ঘটনা অহরহ ঘটছে। ‘এমনকী উঠতি জনপ্রিয় রাজনীতিককে হত্যা করা খুব কমন ঘটনা। এই ধরনের ঘটনায় কোনো মামলা দিলে সেখানে অন্তত ২০/৩০ জনকে আসামি করা হয়।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালতেই শুধু হত্যার অভিযোগে ৮০০টি মামলা বিচারাধীন আছে। জেলায় এমন বিপুল সংখ্যক হত্যা মামলা বিচারাধীন থাকা আদালতও কম নয়।
যেমন জেলা ও দায়রা জজের আদালতে বিচারাধীন প্রায় ৪০০ মামলা। তিনটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হত্যা মামলা আছে আরো ৩০০।
আর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে বিচারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আরো প্রায় ৫০০ মামলা। শুধু কক্সবাজারের আদালতেই প্রায় ২ হাজার হত্যা মামলা রয়েছে।
কলঙ্কময় এক খেতাব
সারা দেশের আদালতগুলির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ জেলা হলো- কক্সবাজার। এখানে প্রতি ৯৫ জনপ্রতি একটি করে ফৌজদারি মামলা রয়েছে।
ঢাকায় এই হার প্রতি ১৩৮ জনে একটি; চট্টগ্রামে ১৫৫ জনে একটি, রাজশাহীতে তা ১৭৪ জনে, বরিশালে ১৮১, পঞ্চগড়ে ২৫৭, রংপুরে ২৬৩ এবং সিলেটে ২৬৯ জনপ্রতি একটি করে ফৌজদারি মামলা রয়েছে।
এই তালিকায় সবার নিচে খুলনা, সেখানে প্রতি ৪৬১ জনে একটি করে ফৌজদারি আইনে মামলা রয়েছে।
২০২১ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন আদালতে দায়ের করা ফৌজদারি মামলার তথ্য সন্নিবেশ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
কক্সবাজার দেশের দক্ষিণাঞ্চলের শেষ প্রান্তের দিকে অবস্থিত একটি শহর। আর পঞ্চগড় হলো সর্ব উত্তরের। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ার দূরত্ব প্রায় ৯২৬ কিলোমিটার। কিন্তু, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের অপরাধ হারে রয়েছে বিশাল ফারাক। সৈকত নগরীতে সংগঠিত অপরাধগুলিও অনেক বেশি সহিংস।
বড় বিভাগীয় শহরগুলো বাদে জেলাগুলোর মধ্যে কক্সবাজারে খুন ও মাদকের মামলা সবচেয়ে বেশি।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম জানিয়েছেন, ফৌজদারি অপরাধে বর্তমানে আদালতে ৯০ হাজারের কিছু বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যার মধ্যে ৩০ হাজার মামলা মাদকের, ১ হাজার রয়েছে হত্যা মামলা। এছাড়া অস্ত্র, মানব পাচার, চোরাচালান ও মানি লন্ডারিং মামলার সংখ্যাও বেশি। গত ৬ মাসেই ফৌজদারি মামলা হয়েছে অনন্ত সাড়ে পাঁচশ; যার মধ্যে ৪০০ ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ (‘আইস’ নামে পরিচিত) উদ্ধার মামলা।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাসিন্দা মিজানুর রহমান তার এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে অপরাধ ও হত্যাকা- বেড়ে চলার ধারাবাহিক ঘটনা গভীর উদ্বেগের সাথে প্রত্যক্ষ করেছেন।
তিনি বলেন, কক্সবাজারে সাধারণত মাদক ব্যবসা কেন্দ্র করেই বেশিরভাগ অপরাধ সংঘটিত হয়। নির্দিষ্ট এলাকায় যারা আধিপত্য বিস্তার করতে পারে- তারাই মাদক কারবারে সুবিধা করতে পারে। ফলে, মাদক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটগুলোর মধ্যে কোন্দল চলে প্রতিনিয়ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যা আজন্ম শত্রুতায় রূপ নেয়। ফলে তাদের মধ্যে হত্যা, পাল্টা হত্যার ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে।
অর্থের কোনো অভাব না থাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা সহজেই তাদের সন্ত্রাসী দলে সদস্য যোগাড় করতে পারে, কিনতে পারে দামি অবৈধ অস্ত্র। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও পাহাড়ি অঞ্চলে অপহরণ এখন নিয়মিত ঘটনা বলেও জানান মিজানুর।
কক্সবাজার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ও প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। এ জেলার সবচেয়ে গুরুতর সংকট ইয়াবা পাচার এবং রোহিঙ্গাদের ঢল।
কক্সবাজারের সাথেই মিয়ানমার সীমান্ত; গভীর বন ও দুর্গম পাহাড়ি এলাকা বেষ্টিত এই সীমান্তে নজরদারি জোরালো না হওয়ায়– প্রতিবেশী দেশ থেকে অবাধে মাদক আসছে। এতে হত্যা ও অপহরণের ঘটনা আরও বেড়েছে।
মিয়ানমার ইয়াবার মতো মাদকের সবচেয়ে বড় উৎপাদক হওয়ায়– পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে ২০১৬ সালে দেশটির সামরিক বাহিনীর দমন অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে। খবর টিবিএসের।
তাদের সাথে সাথে মাদক পাচারের আরও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এসেছে।
তিনি বলেন, এখন ঘন ঘন হত্যা ও অপহরণের মামলা দায়ের হচ্ছে। পর্যটন নগরী পরিণত হয়েছে এক কুখ্যাত অপরাধ নগরীতে।
আবু তাহের জানান, কিছুদিন আগে পুলিশে গণবদলির পর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আরো জটিল হয়েছে। কারণ বদলি হয়ে আসা অনেক পুলিশই স্থানীয় ভাষা রপ্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে।
কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবালের মতে, কক্সবাজার সীমান্ত জেলা হওয়ায়- এখানকার জনজীবনে অস্থিতিশীলতা বেশি।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা-কেন্দ্রিক অপরাধ, মাদক পাচারের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট, খুন, অপহরণ মিলিয়ে দিনকে দিন পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। এই বাস্তবতায়, রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত পাঠানো এবং সীমান্তে কঠোর নজরদারির আহ্বান জানান তিনি।
একইসঙ্গে, বিচারাধীন মামলাগুলোর বিচারকাজ শেষ করে অপরাধীদের সাজা দেওয়া হলে– আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেও মনে করেন তিনি।
মাদক-সংক্রান্ত মামলা বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে শুধুমাত্র রোহিঙ্গা ক্যাম্প-কেন্দ্রিক ফৌজদারি মামলা হয়েছে ২ হাজারের বেশি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-কেন্দ্রিক ১,৬৫০টির বেশি মাদক মামলা হয়েছে। এর বাইরে অস্ত্র মামলা হয়েছে ১৮১টি, আসামির সংখ্যা ৪৮০ জন।
ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা ব্যক্তিরা
ইয়াবা বাণিজ্যের সাথে চিরতরে জড়িয়ে থাকবে আবদুর রহমান বদির নাম। ক্ষমতাসীন দলের সাথে মাদক ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার এক উদাহরণ তিনি।
২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার-৪ আসনে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ছিলেন বদি। ব্যাপক সমালোচনার কারণে তাকে আর নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ, তার বদলে তার স্ত্রীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এবং নির্বাচনে তিনি আসনটি জেতেনও।
অন্ধকার অতীত থাকার পরও আধুনিক যুগের হাতেম তাই- সেজে ২০১৯ সাল থেকে প্রতিমাসে টেকনাফের ৫৬ হাজার দরিদ্র মানুষের মধ্যে চাল বিতরণে বছরে ১৯ কোটি টাকা করে ব্যয় করেছেন বদি।
অথচ ২০১৪ সালে জমা দেওয়া তার নির্বাচনী হলফনামায় বার্ষিক আয় উল্লেখ করা হয় প্রায় ১৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। তারা অনুধাবন করে, ‘ধরাছোঁয়ার’ বাইরে থাকা এসব ব্যক্তিদের এমন প্রস্তাব দিতে হবে যা তারা উপেক্ষা করতে পারবে না।
তারা কক্সবাজারের মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন। এজন্য তাদের অস্ত্র জমা দিয়ে আর কোনোদিন এই ব্যবসায় জড়াবেন না এমন প্রতিজ্ঞা করার শর্ত রাখা হয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, এরপর ২০১৯ সালে কক্সবাজারের প্রায় ১২৩ জন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের অস্ত্র জমা দিয়ে আর মাদক ব্যবসায় না ফেরার শপথ নেয়।
আত্মসমর্পণের সময় বদির দুই ভাইকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে একজন মাদক ব্যবসায় না ফেরার অঙ্গীকার করেন এবং জামিনে ছাড়া পান। তবে এই প্রতিশ্রুতি রাখেননি তিনি। জামিনে মুক্তি পাবার কয়েক মাস পরেই তিনি আবার এই অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
মুক্তি পাওয়া আরেক ইয়াবা ব্যবসায়ী টেকনাফ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারের সাথে দেশের আর দশটি জেলার ভৌগলিক ও ভূরাজনৈতিক পার্থক্য আছে।
‘দ্রুত বিচার শেষ করতে বিশেষ আদালত করা না হলে এই সমস্যার আশু সমাধান নেই। একইসঙ্গে বিশেষ জেলা হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরো বেশি তৎপরতা বাড়ানো দরকার, কৌশল পরিবর্তন করাও জরুরি’- যোগ করেন তিনি।