‘অপউন্নয়নে’ ধ্বংস হচ্ছে সবুজ

বিপ্লব উদ্যানের বর্তমান চিত্র - রনী দে

ভূঁইয়া নজরুল »

নগরীর ষোলশহর মোড়ে বিপ্লব উদ্যান ধ্বংস করা হয়েছে ‘অপউন্নয়নে’। সবুজ উদ্যানে গড়ে তোলা হয়েছে ইট পাথরের জঞ্জাল। অথচ জনাকীর্ণ নগরীতে পাখির কিচির মিচির শব্দ এবং একটু নিরবতার শান্তি পেতে মানুষ এসে বসতো এই উদ্যানে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই স্থানের একটি ইতিহাস থাকায় জননেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর এখানে স্বাধীনতার একটি স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন।

কিন্তু উন্নয়ন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের থাবায় উন্মুক্ত স্থান হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় এখন গড়ে তোলা হয়েছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। যেখানে সন্ধ্যাবেলায় অসংখ্য মানুষ এসে বসতো এই সবুজ চত্বরে শুনতে পেতো পাখির কলতানের শব্দ, সেখানে সন্ধ্যাবেলায় এখন ২৫টি রেস্টুরেন্টে আসা মানুষের হাঁকডাক। এসব রেস্টুরেন্টে বর্জ্যও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে সেই উদ্যানে।


  • ১৯৬১ সালের মাস্টারপ্ল্যানে সংরক্ষণের কথা বলা হলেও বিপ্লব উদ্যান ধ্বংস করা হয়: সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ

  • পরিবেশ ধ্বংস করে নেওয়া প্রকল্পগুলো হলো অপউন্নয়ন: স্থপতি জেরিনা হোসেন


বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মরণে প্রায় দুই একর জায়গায় পাকিস্তান আমলে গড়ে তোলা হয়বিপ্লব উদ্যান। ১৯৬১ সালের মাস্টারপ্ল্যানেও এই উদ্যানের কথা উল্লেখ রয়েছে। উদ্যানে প্রবেশের ফটকে ছিল গাছ দিয়ে বানানো তোরণ, প্রবেশের পর গাছ দিয়ে লেখা ছিল বিপ্লব উদ্যান। ছিল বাটারফ্লাই এর আদলে একটি ছোট্ট সরোবর, সেখানে ছিল শাপলা ফুল। আর নানা প্রজাতির ফুলের গাছের পাশে বসানো ছিল কংক্রিটের ঢালাই করা বেঞ্চ, ছিল কংক্রিটের ছাতা। পরবর্তীতে এই স্থানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনর সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর স্বাধীনতার স্তম্ভ নির্মাণ করেন।

উদ্যানটি বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আনোয়ারুল ইসলাম নামে একজন ডিজাইনার স্বাধীনতার স্তম্ভটি নির্মাণ করেন। কিন্তু এটি নির্মাণ করতে গিয়ে সবুজের কোনো ক্ষতি করা হয়নি। খালি জায়গায় স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়েছিল।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘গত বছর এই নান্দনিক উদ্যানটি ধ্বংস করে এখানে দোকান নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়, যা একজন আর্কিটেক্ট হিসেবে আমার জন্য লজ্জার।’

কিন্তু তখন তো আপনি প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের, আর আপনার হাত দিয়েই তা হয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংস্থা প্রধান যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন চাকুরে হিসেবে আমাদের কিছু করার থাকে না।’

এদিকে মাস্টারপ্ল্যান ও ড্যাপে উদ্যানের এই স্থানটি উন্মুক্ত স্থান হিসেবে এয়ারমার্ক (চিহ্নিত) করা রয়েছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘এভাবে নগরীর উদ্যানগুলো ধ্বংস করে মানুষের বসবাসের পরিবেশ বিনষ্ট করা হয়েছে। একটি কোলাহলপূর্ণ ও জনবহুল নগরীর জন্য এমন উদ্যান খুব প্রয়োজন। অন্যথায় নগরীতে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেবে। মানুষ স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হবে।’

এধরনের উন্নয়নগুলোকে কোনোভাবেই উন্নয়ন বলতে রাজি নন বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি জেরিনা হোসেন। তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন কাজের সাথে পরিবেশের বিষয়গুলো বিবেচনায় আসা দরকার। সরকার এজন্য টেকসই উন্নয়নের কথা বলে। কিন্তু যে উন্নয়নে পরিবেশ ধ্বংস হয় সেগুলো অপউন্নয়ন। এসব অপউন্নয়নের কারণে নগরীর সবুজ ধ্বংস হয়েছে।’

জেরিনা হোসেন আরো বলেন, ‘আজ সিআরবির সবুজ ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেখানে সবুজ এই এলাকাটি রক্ষার জন্য সব ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তারপরও এই স্থানে কীভাবে একটি হাসপাতালের প্রকল্প নেওয়া হয়?’

পরিবেশবাদীদের প্রশ্ন, আজ যারা পরিবেশের সংরক্ষিত স্থানে উন্নয়নের প্রকল্প নিচ্ছেন তারা কি এমন একটি স্থান গড়ে তুলে দিতে পারবেন? আগের বিপ্লব উদ্যান কি এখন আর কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবেন? আজ সিআরবি ধ্বংস করা হলে সিআরবির মতো আরেকটি স্থান কি কেউ গড়ে দিতে পারবেন?

উল্লেখ্য, নগরীর উন্মুক্ত স্থানগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্প ও অপরিকল্পিত নগরায়ণে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ভরাট হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী দীঘিগুলোও।