রোকন রেজা :
দরজা থেকে একটু বাঁদিকে তাকালেই একটা মেয়েকে অ্যাঙ্গেলে দেখা যাচ্ছে। দু’বার তাকালো সঞ্জু। কুমড়োর ফালির মতো পিঠকাটা ভয়েল, হলুদ রঙের বউ কথা কও পাখির মতো। গোলাপী ওড়নায় জড়ানো যৌবন। ড্রাই করা চুল। পুরুষখেকো মায়াবী চোখ। সারাদেহে কৈশোর পেরেনো ম্যাচিউরড সৌন্দর্য। এ রকম মেয়েদের দেখলেই হাত ধরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে পাশাপাশি একটু হাঁটতে, দুটো কথা বলতে। ইচ্ছে করে…
মেয়েটা সামনের সিটের একজনের সঙ্গে কথা বলছে আর কিছুক্ষণ পর পরই হাসছে। ঝরনার মতো খলখলানো সে হাসি। সঞ্জু দেখেছে বেশির ভাগ যুবতীই খলখলিয়ে হাসে। দু:খ-কষ্ট কি তাদের ছুঁয়ে যায় না!
সঞ্জু আরও একবার তাকাল। আর ঠিক তখনই চোখে চোখ পড়ে গেল। ধরে রাখতে পারলো না সঞ্জু। নামিয়ে নিল। প্রথমবারেই কোনো যুবতীর চোখে চোখ রাখা যায় না। চোখ দিয়ে ইলেক্ট্রোপ্লেটিংয়ের আলোর মতো আগুন ছোটে।
বাবলা আর ধনচে গাছের মাথা বাড়ি খাচ্ছে ট্রেনের সাথে। বেশ দূরে দু’একটা চটকা গাছ, শিমুল গাছ। মাঠে-মাঠে আখ। আখের মাথায় ফুল। সাদা সাদা। কাশফুলের মতো। অসম্ভব সুন্দর। সঞ্জুর মনে হয় মানুষ যখন গতিতে থাকে তখন সবকিছুই ভালো লাগে অথবা হতে পারে পাশে বসা এই মেয়েটির কারণেই সবকিছু ভালো লাগছে তার।
সঞ্জু যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে সেই মেয়ে কি এই মেয়ের চেয়েও বেশি সুন্দর! কি জানি! সঞ্জু তাকে দেখেনি। মা দেখেছে। সে গিয়ে দেখবে। যদি এমন হয় এই মেয়েই সেই মেয়ে!
না, তা নিশ্চয় হবে না! গল্প-উপন্যাসে হয়। সিনেমায় হয়। বাস্তবে হয় না।
মেয়েটা গোপনে-গোপনে সঞ্জুর দিকে তাকাচ্ছে। সত্যিই অসম্ভব রূপবতী। সঞ্জুর শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে। সঞ্জুর মনে হয় এরকম মেয়েদের দিকে তাকিয়েই এক জীবন পার করে দেয়া যায়।
তারপর সঞ্জু মেয়েটার চোখে চোখ রাখে। মেয়েটাও। চলতে চলতে দু’পাশের সারি সারি কলাগাছ আর কিছু বস্তি পেরিয়েই ট্রেনটা থেমে যায়।
যশোর স্টেশন।
মেয়েটার সামনের সিট থেকে নেমে যায় দু’জন বৃদ্ধ আর একজন সুদর্শন যুবক। সঞ্জু একটা সিট পায় জানালার পাশে। ট্রেনে ওঠার পর সবাই জানালার পাশের সিটটা খোঁজে। সঞ্জু পেয়ে গেল। লোকাল ট্রেনে সিট নম্বর থাকে না।
মেয়েটা এখন সরাসরি সঞ্জুর সামনে। এখানেই বসেছিল সেই যুবক। সঞ্জুর পাশে একজন বৃদ্ধা, সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। মেয়েটা নিশ্চয় ওই ছেলেটার সঙ্গেই কথা বলছিল আর হাসছিল। সিটের শেষ মাথায় একজন আধবয়সী লোক ঝিমাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই। ট্রেনে উঠলেই কিছু কিছু লোক শুধু ঝিমায়।
সঞ্জুর সামনে সুবাসিত অপূর্ব সুন্দরী। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে মরা বিকেলের বর্ণিল প্রকৃতি। ওটাও অপূর্ব। সঞ্জুর মনে হয় পৃথিবীটাই আসলে অপূর্ব। হয়তো আমরা দেখার ঠিকমতো সুযোগ পাই না।
মেয়েটা তার ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে। কিছুক্ষণ আঙুল চালায় ওর ওপর। ইতিউতি তাকায়। তারপর ব্যাগের মধ্যে কি যেন খোঁজে। হেডফোন বের করে কানে লাগায়। গান শোনে।
সঞ্জু ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে। কবিতার। ঝকঝকে মলাট। প্রচ্ছদে মায়াবী চোখের মায়াবী নারীর মায়াবী মুখ। জলরঙে আর্ট করা।
সঞ্জু যখন বই মেলে কবিতা পড়ে মেয়েটা তাকিয়ে থাকে বইয়ের মলাটের দিকে। তারপর একটু পরেই সঞ্জু বইটা যখন বন্ধ করে। মেয়েটা বলে, এক্সকিউজ মি-বইটা একটু দেবেন?
ওহ সিওর। বইটা এগিয়ে দেয় সঞ্জু।
বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকে মেয়েটা। সঞ্জু বলে, কোথায় যাবেন আপনারা?
এই তো সামনে।
সামনে মানে?
ামনে মানে- খুলনা।
বেড়াতে নিশ্চয়!
না।
তাহলে?
বাড়িতে।
ওহ, বেড়াতে গিয়েছিলেন, তাহলে!
কি করে বুঝলেন!
এই সময়টা বেড়ানোর জন্য খুবই ভালো। বসন্ত ঋতু। প্রকৃতি থাকে লাজ-নম্র। নতুন বৌয়ের মতো। তারপর। সঞ্জু একটু থামে। একটা লম্বা শ^াস টেনে বলে, শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে প্রকৃতিকে।
ঠিক বলেছেন। কবিরা নাকি প্রকৃতি খানিকটা খায়ও শুনেছি। এই ধরুন মায়াবী রাত, রুপালি চাঁদ, মনভাসানো জোছনা।
মেয়েটা এক নিশ^াসে কথাগুলো বলে থামে। তারপর ঠোঁটের দুকোণে মোলায়েম হাসি টেনে বলে, এইসব আর কি!
মেয়েটা বাইরে তাকায়। বাইরে উড়ে যায় পাখি, গাছ,বিদ্যুতের খুঁটি। মেয়েটা বলে, আচ্ছা আপনি কি কবি? মেয়েটির চোখে রঙিন রহস্য খেলা করে। মেয়েটা ওর সাথে হালকা ধরনের রসিকতা করছে কি না সঞ্জু বুঝতে পারে না। এই বয়সের মেয়েরা রসিকতা পছন্দ করে। আশে-পাশের যুবকদের একটু খেলাতে চেষ্টা করে। মজা পায়। রূপ দিয়ে যে অনেক কিছু করা যায়, সেটাই প্রমাণ করতে চায়।
মেয়েটি আবার বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টায়। শেষের দিকে দু’একটা কবিতা পড়ে। তারপর বইটা বন্ধ করে বলে, আপনি কবি না, তবে কবির কাছাকাছি।
মানে?
মানে এখন যারা কবিতা পড়ে তারাও একধরনের কবি। এখনকার কবিতা কবিরা ছাড়া কেউ বোঝে না।
সঞ্জু এ কথার কোনো উত্তর দেয় না। সে অনেকটা ঠিকই বলেছে। সে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে অকারণ হাসার চেষ্টা করে। সঞ্জুও যে কবিতা লেখে এটা বলতে কেমন যেন লজ্জা লাগে তার।
ট্রেনের গতি আবার কমে আসে। সঞ্জুর মনে হয় স্টেশনগুলো যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে আসছে। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে। সুন্দর মুহূর্তগুলো বোধহয় খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যায়।
খটাংখটাং করে একটা ছোট রেলসেতু পার হয়েই ট্রেনটা থামে। জানালা দিয়ে মানুষের উশখুশ মাথা বের হয়। ট্রেনটা থেমেই থাকে। এক ব্রাশ বিক্রেতা জানায়, লাইনে ট্রেন আছে। ক্রস করবে। বেশ কিছুটা সময়ের ব্যাপার। আসলেই লোকাল ট্রেনের ভরসা নেই।
সঞ্জু নেমে আসে ট্রেন থেকে। পিছু পিছু নামে চন্দনা। ট্রেনের মধ্যেই নামটা জানা হয়ে গেছে।
চন্দনার পাশে যে বৃদ্ধা ঘুমাচ্ছেন তিনি চন্দনার মা। চোখে ঠিকমতো দেখেন না। আবছা-আবছা। একটা অপারেশন করা হয়েছে। তাও ওরকমই। ওর সামনে যে যুবকটি বসেছিল সে চন্দনার ছোটভাই-সিহাব। যশোর এম এম কলেজে অনার্স পড়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে।
গোধূলির আলো।
কয়েকটা মাটির ঘর, কয়েকটা কলাগাছ। ঘরের পেছনে বাঁশ রেলিঙের ভেতর দু’ঝাড় রক্তগাদার গাছ। ছোট-ছোট লাল-লাল ফুল। রেলিঙের সঙ্গে বড় বড় ঢোলকলমির গাছ। ঢোলকলমির সবুজ-সবুজ পাতা সঞ্জুর গায়ে এসে লাগছে।
এরই মধ্যে অনেকেই ট্রেন থেকে নেমে পড়েছে। অনেকে এখনও নামছে। হকাররা এখানেও তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখেনি। এই ট্রেনে যে এতোগুলো হকার ছিল ভাবা যায় না। নাকি সামনের স্টেশন থেকে কিছু হকার চলে এসেছে এরই মধ্যে!
চারদিকে হকারের চিৎকার। দু’একটা শিশুর কান্না, সিগারেটের ধোঁয়া, পানের পিক, ব্লাকারের আতঙ্ক। শুধু মাঝে-মাঝে দু’একটা ঢোলকলমির পাতা সঞ্জুর গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। চন্দনা পেছন থেকে ডাকে, ‘শুনুন।’
ডেকেই একেবারে কাছাকাছি চলে আসে। ওর গা থেকে কেমন যেন একটা গন্ধ পায় সঞ্জু । মাতাল করা। সঞ্জুর মনে হয় এ রকম গন্ধ শুধু কুমারী মেয়েদের গা থেকেই আসে।
সঞ্জু ধরেই নিয়েছে এই মেয়েকে ‘ফ্যারে’ ফেলা খুব একটা কঠিন হবে না। ট্রেনে বৃদ্ধা মা, প্রায় অন্ধ। ছোটভাই সিহাব আগের স্টেশনে নেমে গেছে। তাছাড়া এই সূর্যনেভা অন্ধকারে এতটা সাহস করে যখন নেমে এসেছে! বন্যপাখিও যদি পোষাপাখির মতো হাতে এসে বসে, তাহলে একটু ভালোবেসে আবার উড়িয়ে দিলে দোষ কি?
বাঁশ রেলিঙের পাশ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে দুজনের অনেক কথা হয়। জীবনের কথা, যৌবনের কথা। ভালোলাগা-ভালোবাসার কথা।
তারপর ওরা কথা বলতে-বলতে চলে আসে একটা মরা খালের দিকে। ট্রেনটাকে ২০/২২ গজ পেছনে ফেলে।
নবসন্ধ্যায় সজনেপাতায় ঝিরঝিরে বাতাস। চিকচিক করতে-করতে দুটো চামচিকে উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। দূরের ছোট-ছোট মাটির ঘরে আলো দেখা যায় জোনাকির মতো। সাহস করে সঞ্জু চন্দনার বামহাতটা হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। বলে, ‘জানো মেয়ে, তোমাকে খুঁজছি আজীবন-জনম জনম।’
কোনো কবিতার লাইন। সঞ্জু সুযোগ বুঝে কবিতার লাইন মেরে দেয়। চন্দনা ধরতে পারে না।
চন্দনা কথা বলে না। সঞ্জু তাকে আরও কাছে টেনে নেয়। চোখে-মুখে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় আলতো করে। তারপর কবোষ্ণ বুকে শীতল স্পর্শ রাখে। চন্দনা হারিয়ে যায় কোথায় যেন সংজ্ঞাহীনার মতো।
ঠিক তখনই ট্রেনটা হুইসেল দেয়। লাইন ক্লিয়ার। দুজনই দ্রুত হাঁটতে থাকে ট্রেনের দিকে।
সঞ্জু হাসছে না। কথা বলছে না। মুখটা বাড়িয়ে দিয়েছে বাইরে।
আস্তে-আস্তে ট্রেনের গতি বাড়ে। সময় বয়ে যায়। সঞ্জু নেমে যায় দু’স্টেশন পর। চন্দনার চোখে জল টলমল করে। মোটা-মোটা চোখে জল। শ্রাবণের মেঘের মতো। সঞ্জুর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে তুলে নেয়। ধরে রাখে কিছুক্ষণ। তারপর আলতো করে ঘষা দেয় একটা। ওর মা তখনও ওভাবেই ঘুমিয়ে।
রাত ভেসে যায় জোছনার আলোয়। তার কিছুটা ছিটকে পড়ে ভেতরে জানালা দিয়ে। লোকাল ট্রেনে আলো নেই। প্রায় অন্ধকারেই কি যেনো খোঁজে চন্দনা। ঠিক তখনই সঞ্জুর কথা মনে হয়। স্পর্শের উষ্ণতা এখনও দেহ-মনে লেগে আছে। কিন্তু ওর ঠিকানা কি! পেশা! কিছুই তো জানা হয়নি। এমনকি আগের স্টেশনের নামটাও আর মনে করতে পারে না চন্দনা।
সঞ্জু হাঁটছে। ব্রিজটা পার হলেই রিকশা পাওয়া যাবে। মনটা কেমন উদাস হয়ে যাচ্ছে বারবার। চন্দনার মুখটা ভেসে উঠছে শুধু। এতটুকু সময় অথচ অনেক কিছু দিয়ে গেল মেয়েটা। অনেক স্মৃতি, অনেক ভালোলাগা। ভালোলাগা না ভালোবাসা! দূর, ভালোবাসা হবে কেনো! এইটুকু সময়ে ভালোবাসা হয়! ভালোবাসা তো হৃদয়ে-হৃদয়ে। হাজার বছরের।
তাহলে!
তাহলে সঞ্জু যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে সেই স¦প্নকুমারী?
সেও কি তাহলে এ রকম নিশুতি কোনো রাতে….
না,আর ভাবতে পারে না সঞ্জু। বুকের একপাশে কেমন চিনচিন করে ব্যথা করে ওঠে। সে-ই বা সুযোগটা কেন নিল! নিজের কাছেই নিজেকে দোষী মনে হয় তার।
আর একটু হাঁটলেই রিকশা পাওয়া যাবে। অথচ এই পথটুকুই অনেক দীর্ঘ মনে হয় তার কাছে।