ভূঁইয়া নজরুল »
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নগর পরিকল্পনাবিদ সারোয়ার আহমেদ মঙ্গলবার সকাল থেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। তিনি চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালে চিকিৎসার নিতে চেয়েছেন কিন্তু সেখানে কোনো শয্যা খালি নেই। ৫০ শয্যার পুরো হাসপাতাল রোগীতে পরিপূর্ণ। জেনারেল হাসপাতালেও সিট খালি নেই। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর চিত্রও সুবিধার নয়। প্রতিদিন এমন শত মানুষ শ্বাসকষ্ট নিয়ে আইসিইউর জন্য হাসপাতালে ঘুরছেন। এদের মধ্যে অনেকে মারা যাচ্ছেন অক্সিজেনের অভাবে।
ফৌজদারহাট বিআইটিআইডিতে সোমবার স্বপন চক্রবর্তী নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে আইসিইউ সুবিধা না পেয়ে। মুমুর্ষ রোগীদের চিকিৎসার কোনো সুযোগ বিআইটিআইডিতে নেই জানিয়ে হাসপাতালটিতে করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত ডা. সুমন বলেন, আমাদের এখানে করোনা চিকিৎসার জন্য ৩০টি সিট রয়েছে। এখানকার রোগীদের সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন দেয়া ছাড়া আমরা আর কিছু দিতে পারি না। তবে মুমুর্ষ রোগীদের জেনারেল হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় কিন্তু সেখানেও সিট সঙ্কট থাকলে এখানে রেখে দেয়া হয়।
জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিত্র ভয়াবহ। করোনা উপসর্গ রয়েছে এবং করোনায় আক্রান্ত রোগীদের অনেকে অক্সিজেন পাচ্ছে না। এনিয়ে ওখানকার ডাক্তার সোস্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাসও দিচ্ছেন। একটি সিলিন্ডার থেকে অনেক রোগীকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। এতে কেউ পায় কেউ পায় না। এবিষয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. হুমায়ুন কবিরের সাথে। তিনি বলেন, ‘সাধারণ রোগীদের হাসপাতাল হওয়ায় এখানে স্বাভাবিকভাবেই রোগীর চাপ বেশি থাকবে। বর্তমানে ধারণক্ষমতার প্রায় দেড়গুণ রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘করোনায় চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন সাপোর্ট অবশ্যই প্রয়োজন। এরজন্য আমরা কেন্দ্রীয় (সেন্ট্রাল) অক্সিজেন সংযোগের কাজ করছি। একইসাথে ৭টি আইসিইউ বেড স্থাপনের কাজও চলছে। আর তা হয়ে গেলেই চিকিৎসায় একটু শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।’
এদিকে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, করোনা উপসর্গ নিয়ে আবার কেউবা করোনায় মারা যাচ্ছে। তবে করোনার চেয়ে করোনার উপসর্গে মারা যাচ্ছে বেশি। এর কারণ হিসেবে ডাক্তাররা জানান, করোনায় অনেকক্ষেত্রে লক্ষণ না থাকায় হঠাৎ শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে রোগী হাসপাতালমুখী হয়। কিন্তু তখন আইসিইউ সাপোর্ট না পেয়ে অনেকে মারা যাচ্ছে। আবার নমুনা পরীক্ষার ধীরগতি ও ভোগান্তির কারণে অনেকে পরীক্ষাও করাতে পারছে না, ফলে উপসর্গ নিয়েই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে।
মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত জেনারেল হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে দুই জনের মৃত্যু হয়। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, ‘করোনা চিকিৎসায় রোগীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় অক্সিজেন এবং হেপারিন নামের একটি ইনজেকশন। স্বাভাবিক সময়ে সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন দেয়া হলেও মুমুর্ষ অবস্থায় অক্সিজেনের চাপ বেশি প্রয়োজন হয়। সেমময় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপোর্ট খুব কার্যকর এবং একইসাথে হাইফ্লো নসল ক্যানোলা থাকলে খুব সহজে রোগী অক্সিজেন সাপোর্ট পেয়ে থাকে।’
তিনি আরো বলেন, আইসিইউ সাপোর্ট কিংবা ভেন্টিলেশনের কোনো প্রয়োজন নেই। এতে রোগীদের মধ্যে আরো বেশি ভয় কাজ করে। অক্সিজেন ফ্লো বাড়াতে পারলেই যথেস্ট। এই ফ্লো বাড়াতে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের মধ্যমে হাইফ্লো নজল ক্যানোলা দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করা হলে খুব দ্রুত অক্সিজেন পেয়ে থাকে রোগী। স্বাভাবিক হিসেবে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৫ শতাংশ মুমুর্ষ হয়ে থাকে, তাই তাদের জন্য এধরনের সাপোর্ট প্রয়োজন।
একই মন্তব্য করেন চট্টগ্রামে ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান নির্বাহি ডা. বিদ্যুৎ বড়–য়া। তিনি বলেন, আইসিইউ বেড কোনো বিষয় নয়, মূল ফ্যাক্টর হলো অক্সিজেন সরবরাহ কত দ্রুত হচ্ছে এবং রোগীর প্রতি কেয়ারিং। সাধারণ আইসোলেসনে রেখেও ভাল কেয়ারিংয়ের মাধ্যমে রোগীদের সুস্থ করা যায়, আমরা এই কাজটিই করছি। আর একারণে আমাদের এখানে করোনা রোগীদের সুস্থতার সাফল্যের হার বেশি। মাত্র একজন রোগী মারা গেছেন, তারপরও তিনি হাসপাতালে ছিলেন না, হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে চলে যাওয়ার পর মারা যান। এপর্যন্ত ৯০ জন রোগী ভর্তি হয়ে ৫১ জন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ।
এদিকে করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের চিত্র ভাল নয়। মাত্র কয়েকদিন আগে জেনারেল হাসপাতালে যুক্ত করা হয় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যুক্ত করার কাজ চলছে এবং বিআইটিআইডিতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন নেই। করোনা চিকিৎসায় নতুনভাবে যাত্রা শুরু করা হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালেও সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ নেই, রেলওয়ে হাসপাতাল শুধু আইসোলেসন থাকার জন্য ব্যবহৃত হবে সেখানেও এই সুবিধা নেই।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চট্টগ্রামে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ১৯ জন মারা গেছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সোমবার ২১ জনের মৃত্যুর পর আজ মঙ্গলবার সকালে মারা গেল আরো দুইজন। এদের মধ্যে ১৮ জন করোনা উপসর্গ নিয়ে এবং পাঁচজন করোনা আক্রান্ত রোগী।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে এপর্যন্ত ৩,১৯৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং এদের মধ্যে মারা গেছেন ৮০ জন ও সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন ২২৭ জন। এই নগরীতে করোনা চিকিৎসার জন্য একমাত্র ভরসা জেনারেল হাসপাতাল (১১০টি বেড রয়েছে)। এছাড়া ফিল্ড হাসপাতালে ৫০টি ও বিআইটিআইডিতে ৩০টি এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০০টি বেড রয়েছে। এছাড়া হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১০০টি বেড থাকলেও জনবল সঙ্কটের কারণে সবগুলো সচল করা যাচ্ছে না। কোভিড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণার পরও ফয়’স লেকের বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল ও ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল এখনো রোগী ভর্তি কার্যক্রম শুরু করেনি।
টপ নিউজ