৬০ বছরেও হয়নি সংযোগ সড়ক

সদরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু

এ রোডটি অনেক আগেই চালু করা প্রয়োজন ছিল : খোরশেদ আলম সুজন
রোডটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে কোতোয়ালী ও নিউমার্কেট এলাকা যানজটমুক্ত হবে : ডিসি ট্রাফিক
প্রয়োজনে ৬০০ মিটার দীর্ঘ ওভারপাস হতে পারে : বিশেষজ্ঞদের অভিমত

ভূঁইয়া নজরুল :

৬০ বছরেও হলো না সদরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন চাক্তাই মেরিনার্স সড়ক নামে ফিরিঙ্গীবাজার থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত অংশ করলেও ফিরিঙ্গাবাজার ব্রিজঘাট থেকে সদরঘাট মোড় পর্যন্ত প্রায় ৬০০ মিটার রোড এখনো অবমুক্ত হয়নি। আর তা না হওয়ায় স্ট্র্যান্ড রোডের গাড়ি শাহ আমানত সেতু থেকে কোতোয়ালী মোড়, নিউমার্কেট ও সদরঘাট হয়ে প্রবেশ করতে হয়। এতে যানজট বাড়ছে। এছাড়া ভারী যানবাহন অনেক সময় কবি নজরুল ইসলাম সড়ক দিয়ে সদরঘাট রোডে চলাচল করলেও আবাসিক এলাকা হওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।
কবি নজরুল ইসলাম সড়কের দুর্ঘটনা ও কোতোয়ালী-নিউমার্কেট এলাকায় যানজট কমিয়ে আনতে এখন এ ৬০০ মিটার অংশের রোডটি খুলে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। তিনি বলেন, ‘এ রোডটি সময়ের দাবি। ইতিমধ্যে রোডটি চালু করে দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের সাথে বৈঠক করেছি। তিনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।’
কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম ২০১৩-১৪ সালের দিকে চাক্তাই মেরিনার্স সড়ক নামে ফিরিঙ্গীবাজার থেকে শাহ আমানত সেতু সড়কটি নির্মাণ করলেও তা সদরঘাট পর্যন্ত নির্মাণ করেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এম মনজুর আলম বলেন, ‘সদরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত নদীর পাড় দিয়ে এ রোডটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রথম ধাপে আমরা ফিরিঙ্গীবাজার থেকে শাহ আমানত সেতু অংশ পর্যন্ত করেছি এবং দ্বিতীয় ধাপে ফিরিঙ্গীবাজার ব্রিজঘাট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত করার পরিকল্পনা ছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘এ রোডটি বাস্তবায়ন করা গেলে স্ট্র্যান্ড রোডের সাথে শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কের নেটওয়ার্ক হয়ে যাবে। আর এতে বারিক বিল্ডিং থেকে গাড়িগুলো সহজেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে যাতায়াত করতে পারবে।’
কমবে কোতোয়ালী ও নিউমার্কেট এলাকার যানজট
মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘নদীর পাড় দিয়ে ৬০০ মিটার এ রোডটি নির্মিত রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতায় থাকা রোডটি সাধারণ পরিবহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেই স্ট্র্যান্ড রোডের সাথে চাক্তাই মেরিনার্স সড়কের সংযোগ হয়ে যাবে। আর তা করা গেলে কোতোয়ালী মোড় ও নিউমার্কেট মোড়ের যানজট থাকবে না।’
তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে দেয়া প্রস্তাবনায় এই রোডটি উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
পরিকল্পনাবিদরা কি বলেন?
সদরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করার প্রস্তাবনা ছিল জানিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর ট্রান্সপোর্টেশন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়–য়া বলেন,‘ বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার কিংবা আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার করার আগে এই রোডটি (সদরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত) করার প্রস্তাবনা ছিল চট্টগ্রাম মহানগরীর মাস্টারপ্ল্যানে। কিন্তু অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে অন্যান্য প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় যানজটসহ নানা দুর্ভোগ হচ্ছে।’
সদরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত রোডটি প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘১৯৬১ এবং ১৯৯৫ উভয় মাস্টারপ্ল্যানেই এ রোডটি সবার আগে বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করার ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লাইটারেজ জেটি (ছোটো জাহাজ ভেড়ানোর জেটি) নির্মাণ করে।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতায় থাকার বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন,‘ওখানে বন্দর কর্তৃপক্ষের কিছু নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ ভাড়া দিয়েছে। ভাড়ার শর্ত শিথিল করে রাস্তাটি অবমুক্ত করে দিলেই হয়। চট্টগ্রামের স্বার্থে অবশ্যই তা করা যেতে পারে।’
৬০০ মিটার জায়গায় এখন কি রয়েছে?
ফিরিঙ্গীবাজার ব্রিজঘাট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত এলাকায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নতুন করে ৪০০ মিটার দীর্ঘ চারটি জেটি নির্মাণ করেছেন। এছাড়া গত বছর ওয়াটার বাসের জন্য একটি জেটি নির্মাণ করা হয়েছে, র‌্যাংকসের একটি জেটি এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি জেটি গ্রেট বেঙ্গল নামে একটি কোম্পানিকে বরাদ্দ দিয়েছেন। নদীর অংশে জেটি থাকলেও রাস্তার অংশটি পুরোপুরি নির্মিত অবস্থায় রয়েছে। ব্রিজঘাটের অংশে গেট লাগিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আনসার মোতায়েন করেছে এবং সদরঘাট অংশে একটি গেট রয়েছে জেটি থেকে মালামাল বের করে নিয়ে আসার জন্য। এছাড়া লাইটার জেটিগুলো চালু হলেও এই রোড দিয়ে গাড়িগুলো ব্রিজঘাট ও কোতোয়ালী মোড় দিয়ে বের হয়ে আসবে। ইতিমধ্যে চারটি লাইটার জেটি চার শিল্পগ্রুপকে বরাদ্দ দিলেও এখনো এগুলো সচল হয়নি।
বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
এবিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন,‘ ইতিমধ্যে এখানে চারটি লাইটার জেটি নির্মিত হয়েছে। লাইটার জেটির গাড়িগুলোর প্রবেশ ও বের করার জন্য একটি প্ল্যান করা হচ্ছে। এখানে রোড করার বিষয়ে যদি জনমত থাকে তাহলে সম্ভাব্যতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
হতে পারে ৬০০ মিটার দীর্ঘ ওভারপাস
প্রকৌশলী সুভাস বড়–য়া বলেন, আমাদের বন্দর যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনিভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। ছোটো ছোটো ওভারপাস অনেকসময় খুবই ফলপ্রসূ হয়। সদরঘাট থেকে ব্রিজঘাট পর্যন্ত অংশে যদি একটি ওভারপাস করা যায় তাহলে নিচ দিয়ে বন্দরের জেটির জন্য ব্যবহৃত গাড়িগুলো যাতায়াত করতে পারবে এবং ওভারপাস দিয়ে সাধারণের চলাচলের সুবিধা হবে।
তিনি আরো বলেন, বিশ্বের অনেক দেশ নগরগুলোতে এ ধরনের অসংখ্য ওভারপাস নির্মাণ করেছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘বন্দরের উন্নয়ন স্বার্থে যদি নিচ দিয়ে রোডটি সচল করা না যায় তাহলে ওভারপাস নির্মাণ করা যায়। এতে বন্দর ট্রাফিক ও সিটি ট্রাফিক উভয়ের জন্যই নিরাপদ হবে।’ এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সিটি ট্রাফিকের জন্য বিমান বন্দর সড়কে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে ৪২০ মিটার দীর্ঘ একটি ওভারসপাস নির্মাণ করেছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম মহানগরীতে দিন দিন যানজট বাড়ছে। বিমানবন্দর থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামে যাতায়াতের জন্য এখন অনেক পথ ঘুরে সিডিএ এভিনিউ কিংবা নিউমার্কেট হয়ে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু এই ৬০০ মিটার অংশটি খুলে দেয়া হলে বারিক বিল্ডিং থেকে স্ট্র্যান্ড রোড হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ যাতায়াত করতে পারবে।