২০২২ সালেই ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার

কালুরঘাট সেতু ট্রেন চলাচলে বাধা হবে না

কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন। সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথের মাধ্যমে। বদলে যাবে দেশের পর্যটন খাত। ২০২২ সালেই পূরণ হবে ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার যাওয়ার স্বপ্ন। সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাকের এই প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন মফিজুর রহমান। প্রকল্পের আদ্যোপান্ত নিয়ে প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলেন সুপ্রভাতের প্রধান প্রতিবেদক ভূঁইয়া নজরুল।

সুপ্রভাত বাংলাদেশ : শত বছর আগের এই পরিকল্পনাটি এতোদিন বাস্তবায়ন হয়নি কেন?
মফিজুর রহমান : অনেক বছর আগে এই প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালের এপ্রিলে ইকোনমিক এন্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া এন্ড দ্যা প্যাসিফিক (এসকেপ) কমিশন অধিবেশনে সম্মতিপ্রাপ্ত ‘এশিয়ান ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সম্পাদিত সমীক্ষায় ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের তিনটি ইউরো-এশিয়া সংযোগ রোডের মধ্যে সাউদার্ন করিডোর অন্যতম রুট। সাউদার্ন করিডোর-১ এর অংশ হিসাবে বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ।

সুপ্রভাত : এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য কি?
মফিজুর রহমান : এই প্রকল্পটি মিয়ানমার সীমান্তের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত নির্মাণ করার কথা থাকলেও প্রথম পর্যায়ে এখন রামু থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে তা রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত যাবে। তবে এই প্রকল্পটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের নেটওয়ার্কের একটি অংশ। একইসাথে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনেও এই রেলপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এরমধ্যে পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা। পর্যটক ও স্থানীয় জনসাধারণের জন্য নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের ব্যবস্থা করা। একইসাথে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রয়েছে ৯টি ( দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার) স্টেশন।

সুপ্রভাত : মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গড়ে উঠছে সমুদ্র বন্দর। মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে আরো অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এই রেলপথ মাতারবাড়ি বন্দরের সাথে যুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি?
মফিজুর রহমান : মাতারবাড়ি বন্দর নিয়ে আলোচনা হওয়ার সাথে সাথে তিন বছর আগেই আমরা এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছি। এই প্রকল্প শেষ হওয়ার পর চকরিয়া থেকে মাতারবাড়ির দিকে ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।

সুপ্রভাত : আধুনিক রেলপথ নির্মাণে অন্যতম নিয়ামক লেভেল ক্রসিং না থাকা। এই প্রকল্পে বিভিন্ন
শ্রেণির ৯৬টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এগুলোর বিষয়ে সমাধান কি?
মফিজুর রহমান : লেভেল ক্রসিং কমিয়ে আনা গেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেমন কমিয়ে আনা যায় তেমনিভাবে সড়কপথে চলাচলকারী মানুষ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পায়। এই প্রকল্পে অনেকগুলো লেভেল ক্রসিং রেললাইনের নিচ দিয়ে যাবে। এছাড়া গ্রামীণ কিছু রাস্তা ক্রস করেছে যেখানে মানুষের চলাচলের জন্য আন্ডারপাস করা যায়নি।

সুপ্রভাত : এই রেলপথের একটি অংশে রয়েছে চুনতি অভয়ারন্য । যেখানে হাতি চলাচলের রুটও রয়েছে। যদিও প্রকল্পের আওতায় হাতি চলাচলের জন্য আন্ডারপাস রাখা হয়েছে। বাস্তবে এর প্রতিফলন কি হতে পারে?
মফিজুর রহমান : অর্থায়নকারী সংস্থা এডিবি তাদের শর্তে বলেছে হাতিদের পুনর্বাসন করতে হবে। সেই হিসেবে স্থানীয়দের পরামর্শ অনুযায়ী এবং ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে আমরা হাতি চলাচলের রুটগুলো চিহিৃত করি। আর সেই স্থানগুলোতে আন্ডারপাস নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। একইসাথে হাতিগুলো যাতে নির্ধারিত আন্ডারপাস দিয়ে চলাচল করে সেজন্য তাদেরকে অভ্যস্ত করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।

সুপ্রভাত : কিভাবে অভ্যস্ত করা হবে?
মফিজুর রহমান : রেললাইনের পাশে এমনভাবে ফেন্সিং দেয়া হবে যাতে হাতিগুলো অনির্ধারিত পয়েন্ট দিয়ে চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়ে ধীরে ধীরে নির্ধারিত আন্ডারপাসের দিকে আসে। একইসাথে পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় হাতিগুলো এক জায়গায় যাতে তাদের খাবার পায় সেজন্য বন বিভাগের সহায়তায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে হাতিগুলো যেখানে থাকবে সেখানেই খাবারের সংস্থান করা হবে। আর তা করা গেলে হাতিগুলো রেল লাইন পার হয়ে অন্য এলাকায় যাওয়ার চেষ্টা করবে না।

সুপ্রভাত : ট্রেন চলার সময় হাতির পাল রেল লাইনের উপর চলে আসা নিয়ন্ত্রণে আর কোনো প্রযুক্তি কি ব্যবহার করা হচ্ছে?
মফিজুর রহমান : হুম, আমরা কিছু গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। লাউয়াছড়ায় প্রাথমিকভাবে তা পাইলট আকারে বাস্তবায়নের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। তা করা গেলে নির্ধারিত দূরত্বে হাতি থাকলে এই সংকেত ট্রেনের চালক পেয়ে যাবে এবং ট্রেনটি ধীরে অতিক্রম করবে।

সুপ্রভাত : কক্সবাজার স্টেশনে পর্যটকদের জন্য বিশেষ কি সুবিধা থাকছে?
মফিজুর রহমান : তরুণ প্রজন্ম যাতে হোটেল খরচ বাঁচিয়ে ঘুরতে পারে সেজন্য স্টেশন ভবনে একটি ব্লক রাখা হয়েছে। যেখানে লকার সুবিধা থাকবে। অর্থাৎ যাত্রীরা সেই লকারে তাদের ব্যাগ রেখে সৈকতে গোসল ও ঘুরাঘুরি করে স্টেশনের নির্ধারিত স্থানে গোসল করতে পারবে। সেখানে গোসল করে লকার থেকে ব্যাগ নিয়ে তারা চাইলে রাতের ট্রেনে আবারো ঢাকার উদ্দেশ্যে ফিরতে পারবে। এজন্য আমরা ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেন সার্ভিস বেশি রাখবো।

সুপ্রভাত : তাহলে চট্টগ্রামের যাত্রীরা কিভাবে যাবে?
মফিজুর রহমান : ষোলশহরে একটি বড় স্টেশন করা হবে। সেই স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের যাত্রীরা ঢাকা থেকে আসা ট্রেনে উঠতে পারবে এবং একইসাথে কক্সবাজার থেকে আসার পথে নামতেও পারবে। এজন্য ফৌজদারহাট থেকে ষোলশহর পর্যন্ত একটি নতুন রেললাইন বসানো হবে। এতে ঢাকা থেকে আসা ট্রেনগুলোকে আর চট্টগ্রাম স্টেশন হয়ে যাতায়াত করতে হবে না।

সুপ্রভাত : দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেল লাইন নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত মিটার গেজ রেললাইন। কালুরঘাট সেতুতে আবার বসছে ডুয়েল গেজ। এগুলোর সমন্বয় কিভাবে হবে?
মফিজুর রহমান : ফৌজদারহাট থেকে ষোলশহর হয়ে দোহাজারী পর্যন্ত নতুন একটি প্রকল্পের আওতায় ডুয়েল গেজ রেললাইন বসানো হবে। একইসাথে ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রয়েছে। টঙ্গী থেকে আখাউড়া এবং লাকসাম থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ একটি প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেললাইন বসানোর কাজ চলছে। পুরো রুটে ডুয়েল গেজ রেললাইন বসতে আরো পাঁচ থেকে ছয় বছর লাগতে পারে। এর আগে মিটারগেজ রেললাইন দিয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চলাচল করবে।

সুপ্রভাত : কাজের অগ্রগতিতে দেখা যাচ্ছে ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপনের কাজ। কিন্তু কালুরঘাট সেতু এখনো নির্মাণ কাজ শুরু করেনি। এটি করতে প্রায় তিন বছর সময় লাগতে পারে। তাহলে কি কালুরঘাট সেতু নির্মাণ না হলে ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার যাওয়া যাবে না?
মফিজুর রহমান : যাওয়া যাবে না কেন? অবশ্যই যাওয়া যাবে। কালুরঘাট সেতুর উপর দিয়ে এখনো ট্রেন চলাচল করছে। নতুন সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই রেললাইন দিয়েই ট্রেন চলবে। তবে সেতুটি জরাজীর্ণ হওয়ায় আমরা এই সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন ধীরে চালাতে হবে।

সুপ্রভাত : তাহলে দেখা যাচ্ছে নতুন সেতু নির্মিত না হলেও ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার যাওয়া যাবে?
মফিজুর রহমান : অবশ্যই যাওয়া যাবে। ২০২২ সালে ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার যাওয়ার উদ্দেশ্যে পুরোদমে কাজ চলছে।