১০ জানুয়ারি’৭২ এ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ : শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার রূপরেখা

সুভাষ দে »

আমাদের স্বাধীনতার স্বাদ পূর্ণ হলো বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে। দুঃখ- বেদনা-আত্মদানের মাঝে জাতির যে সুবর্ণগাথা রচিত হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে এই নবীন জাতির আলোর পথে যাত্রা শুরু হলো সেইদিন থেকে, যেদিন জাতির পিতা স্বদেশে বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন করেন। লক্ষ লক্ষ জনতা রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা জানালো সেই মৃত্যুঞ্জয়ী বীরকে যার নামে লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা জনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। কোটি শরণার্থী আর অবরুদ্ধ স্বদেশবাসী যাঁর মুক্তি আর জীবনের জন্য প্রতিদিন প্রার্থনা করেছে। বাঙালির সেই প্রাণপ্রিয় নেতা-যাঁর জন্য পাকিস্তানি জল্লাদ শাসকরা ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত রেখেছিল, কারাগারের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিলো- যে নেতা বলেছিলেন, আমাকে হত্যা করা হলে আমার লাশ যেন আমার দেশ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়-বাঙালির সেই প্রিয় মানিক দেশবাসীর মাঝে ফিরে এলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, বিকেলে, রমনা রেসকোর্সে বিজয়ী বীরের বেশে, বীর জাতির লক্ষ কোটি মুক্তিযোদ্ধা-জনতার কাছে।
২৫ মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার খবরে বাঙালি জাতি সশস্ত্র বিদ্রোহের পথে অগ্রসর হয়। অথচ তাদের তেমন প্রস্তুতি ছিলো না। ইপিআর পুলিশ, সেনাসদস্য যার যার ব্যারাক থেকে পালিয়ে এসে ছাত্রজনতাকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। এ এক মরণপণ লড়াই। পাকিস্তানিরা মার্চ এর শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা, গুলিগোলা, রসদ পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসে। বাঙালিদের কাছে ছিলো বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ‘যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’। শহর-বন্দর গ্রাম-গঞ্জে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। পাকিস্তানিদের শহরে দখল কায়েম করতে দেড়-দুই মাস সময় লেগে যায়। ইতিমধ্যেই ছাত্রজনতা, সেনাসদস্য, পুলিশ, আনসার, বিডিআর, নিয়মিত সৈনিক ভারতে কয়েকদিনের গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসেই পাকিস্তানি আর তাদের দোসরদের ওপর গেরিলা হামলা শুরু করে দেয়। ততদিনে প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুলকে উপ-রাষ্ট্রপতি (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁকে) তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নিয়মিত সেনা, এফএফ, বিএলএফ ও অন্যান্য স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দলের কর্মীসমর্থকদের নিয়ে বিশাল গেরিলা বাহিনী ও নিয়মিত বাহিনী গড়ে ওঠে। এদের সাথে ছিলো ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতা।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কেননা দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ ছিলো স্বাধীনতার পক্ষে। সমগ্র পূর্ব বাংলায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ঘরে ঘরে। অবরুদ্ধ স্বদেশে কোটি কোটি মানুষ, সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, গৃহবধূ, তরুণ সকলেই মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ছিলো-স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো। বিশ্বের স্বাধীনতার ইতিহাসে এটি ছিলো অভাবিতপূর্ব ঘটনা। সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় আর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন তিনি, যার প্রতিফলন হয়েছে ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে। বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ঐ গণরায়েই ঘোষিত হয়েছিলো। ৭ মার্চের স্বাধীনতা আর মুক্তির সেই আবেগময় ভাষণ বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে-সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতায় দীক্ষিত করে দিয়েছিলো। তাই আর কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন হয়নি। এটা অভূতপূর্ব যে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ম্যাগনাকার্টা হিসেবে সকল বাঙালি নিয়েছিলো, ২৫ মার্চের পাকিস্তানিদের আঘাতের পর প্রত্যাঘাতে বিন্দুমাত্র দেরি হয়নি। ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামে বাঙালি বিজয় অর্জন করেছে পাকিস্তানি বাহিনীর দর্পচূর্ণ করে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২, পাকিস্তানিদের পরাজয়ের পর বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমানকে আটকে রাখার সকল প্রকার বৈধতা হারিয়েছে পাক কর্তৃপক্ষ। তাই শেখ মুজিবকে সসম্মানে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রবল হয়ে উঠেছিলো। পাকিস্তান সরকার ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছিলো কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তান গোপনে শেখ মুজিবকে হত্যা করবে-এ রূপ আভাস দিয়ে তা বন্ধ করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের কাছে বার্তা পাঠান। ইন্দিরা গান্ধী এ লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে সেপ্টেম্বরে ইউরোপ ও আমেরিকা সফর করেন। অবশ্য এর আগে ভারত- সোভিয়েত চুক্তি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম জোরদার করে এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে মার্কিন-চীনের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়। গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব, বিশ্বশান্তি পরিষদ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও শেখ মুজিবের প্রাণরক্ষায় বিশ্ব জনমত গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধু ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের পর পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরাপত্তা ও অবাঙালিদের কথা ভেবে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয় আন্তর্জাতিক চাপ, পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরাপত্তা-এসব বিবেচনায় ৮ জানুয়ারি’৭২ পাকিস্তান সরকার বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকার রেসকোর্সে জাতির পিতা ১৭ মিনিটের যে ভাষণটি দেন, সেটি ছিলো স্বাধীনতাত্তোর দেশকে গড়ে তোলার ‘ম্যাগনাকার্টা’, অর্থনৈতিক-সামাজিক, রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি। তিনি তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি, রাষ্ট্র কাঠামোর ধরণ, পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে তাদের এদেশীয় দোসরদের বিচার, বিশ্ববাসীর প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান, ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, প্রতিহিংসাপরায়ণ না হওয়া, আইনশৃঙ্খলা হাতে না নেওয়া, দেশ পুনর্গঠনে শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি এবং দেশবাসীর করণীয় সম্পর্কে বিশদ দিকনির্দেশনা দেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়দানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় জনগণের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানান। কৃতজ্ঞতা জানান সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি, তিনি মার্কিন জনগণকেও ধন্যবাদ জানান, তবে সে দেশের সরকারকে নয়। তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হবে যদি মানুষ ভাত কাপড় না পায়, শান্তিতে বসবাস করতে না পারে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দর্শনের মূলভিত্তি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বর্ণনা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র, পুলিশ, ইপিআরসহ দেশবাসীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তাঁর ভাষণে বারবার বাংলাদেশ, বাংলাভাষা, বাঙালি জাতি, বাংলার মাটি, প্রকৃতি বারবার এসেছে। তিনি তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত চলছে বলেও দেশবাসীকে হুঁশিয়ার করে দেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ১৭ মিনিটের ভাষণে যেভাবে বাঙালির ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা, সংগ্রাম, প্রতিরোধের বর্ণনা দিয়েছেন, দেশবাসীর করণীয় কি হবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, শত্রুর প্রতি প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন অনুরূপভাবে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণেও দেশবাসীকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, দেশ পুনর্গঠন, জনগণের করণীয়, রাষ্ট্রীয় মূলনীতির বাস্তবায়নসহ একটি সম্পূর্ণ রূপরেখা দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস উপমহাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করেছে। বঙ্গবন্ধু ১ বছরের মধ্যেই সংবিধান প্রণয়ন করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। তাঁর পররাষ্ট্র নীতির সুফল আসতে শুরু করে। বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৩ সালে জাতীয় স্বাধীনতা ও বিশ্বের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অবদান রাখার জন্য বিশ্বশান্তি পরিষদ সর্বোচ্চ সম্মান ‘জুলিওকুরি’ পদকে তাঁকে ভূষিত করে ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে ঢাকায় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে।
বিশ্বশান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রমেশ চন্দ্র তাঁকে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অলিজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আমরা শোষিতের পক্ষে’। ঐ সম্মেলনে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুর অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি’। এর পরের বছর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। তিনি ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের সংগঠন ওআইসির সদস্যপদ লাভ করে এবং বঙ্গবন্ধু লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন।
বিশ্বশান্তি, জাতীয় মুক্তি ও দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের কারণে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববরেণ্য নেতায় অভিষিক্ত হন। তাঁর শোষিতের গণতন্ত্র, মিশ্র অর্থনীতি, প্রশাসনিক রূপান্তর, কৃষি সংস্কার কর্মসূচি জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির পক্ষে সহায়ক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যায়ক্রমে সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছেন। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে বিশ্লেষণ করে, পরিমার্জন করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়াই গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির রাজনৈতিক-সামাজিক দায়িত্ব হোক।
লেখক : সাংবাদিক