হেমন্তের গল্প

ওয়াহিদ ওয়াসেক :

‘শরতের পর পাকা ধানের শীষ নিয়ে আসে হেমন্ত। শুরু হয় ধান কাটা। এ সময় কৃষকের ঘর সোনালি ফসলে ভরে ওঠে। নবান্নের উৎসব ঘরে ঘরে আনন্দ নিয়ে আসে।’ পাঠ্যবইয়ে পড়ছে মুনালিসা।

মুনালিসাকে কেহ মুনালিসা বলে ডাকে না। স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠী থেকে নিয়ে পরিবারের সবাই তাকে মুন বলে ডাকে। মুন ইংরেজি শব্দ। এর অর্থ চাঁদ। আসলেই মুনালিসা চাঁদের মতই সুন্দর। এজন্যই সবাই তাকে মুন বলে ডাকে।

মুন ঢাকা শহরের একটি প্রাইভেট স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। পড়ালেখায় ভীষণ ভালো। বাবার চাকরি সূত্রে ও ঢাকায় থাকে। মুন কখনো গ্রাম দেখেনি। ওর জন্মও হয়েছে ঢাকায়। বাবা একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তেমন ছুটি পান না। তাই মাঝেমধ্যে দাদু, দিদা, ছোটোচ্চু মুনকে ঢাকায় গিয়ে দেখে আসে।

সন্ধ্যায় মুন স্কুলের হোমওয়ার্ক নিয়ে বসে আছে। মা ওর ডায়েরি চেক করছেন। কী কী হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়েছে। বাংলা স্যার হোমওয়ার্ক দিয়েছেন ‘হেমন্তকাল সম্পর্কে তুমি কী জানো? এ সময় কী কী হয়? আলোচনা কর। প্রশ্নটি পড়তেই মোবাইল ফোনের রিং বেজে উঠল। মোবাইলটি চার্জে রাখা। মুন দৌড়ে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো….

মুন, কেমন আছিস?

ভালো আছি দিদা। তুমি কেমন আছ?

ভালো আছি বোন। কি করছিস তুই?

দিদা এই তো হোমওয়ার্ক করছি।

তোর আব্বু, আম্মু কেমন আছে?

ভালো আছে দিদা। দিদা, দাদু কই? দাদু কেমন আছে?

দাদু ভালো আছে। হাটে গেছে। আজকে তো হাটবার। এজন্যই আজকে হাট থেকে কাস্তে, পুজো, কুলো, চালুন এগুলো কিনতে হবে। এগুলো হাটবার ছাড়া পাওয়া যায় না।

আচ্ছা। দিদা, এগুলো দিয়ে কী হবে?

ওমা তুই জানিস না। আর তুই জানবিও বা কী করে! তুই তো ঢাকায় থাকিস।

আচ্ছা। আগে বল এখন কোন কাল চলছে?

জানি না দিদা।

জানিস না! এখন হেমন্তকাল।

মনে পড়ছে দিদা।

জানো দিদা? আজকে আমাদের বাংলা স্যার হেমন্তকাল নিয়ে হোমওয়ার্ক দিয়েছেন।

কী হোমওয়ার্ক দিয়েছেন?

বলেছেন, হেমন্তকাল সম্পর্কে কী জানি? এ সময় কী কী হয়? তা খাতায় লিখে নিতে।

ওহ, আচ্ছা। তুই কি পারবি হেমন্তকাল সম্পর্কে লিখতে? তুই তো হেমন্তকাল কী জানিসই না!

না, দিদা। আমি পারব না। বরং তুমিই বলে দাও। আমি লিখি।

আহা! ঠিকাছে, ল্যাখ। আমি বলে দিচ্ছি।

দাঁড়াও দিদা। আমি খাতা, কলম হাতে নিই। বলো দিদা…

ল্যাখ…

বাংলা ছয় ঋতুর চতুর্থ ঋতু হেমন্তকাল। বাংলা বারো মাসের আশ্বিন ও অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে হেমন্তকাল হয়। হেমন্ত হচ্ছে শরতের পরের ঋতু। আর শীতের পূর্ব ঋতু। এজন্যই হেমন্তকে শীতের পূর্বাভাস বলা হয়। এ সময় একটু একটু করে শীত পড়ে। সকালে একটু-আধটু কুয়াশা দেখা যায়৷ দূর্বাঘাসেও শিশির জমে থাকে।

দিদা, আমরা তো কুয়াশা দেখি না। আর দূর্বাঘাস কী? মুনের প্রশ্ন শোনে মা নিরবে হাসেন।

কথা বলিস না। আগে ল্যাখ। পরে সবই বুঝিয়ে দেব।

হেমন্তকাল আসে পাকা ধানের শীষ নিয়ে। এ সময় ধান কাটা শুরু হয়। কৃষকের ঘর সোনালি ফসলে ভরে ওঠে। ধান কাটার পর শুরু হয় নবান্ন উৎসব। এ সময় নতুন চালের পিঠা দিয়ে তৈরি করা হয় ফিরনি, পায়েস আর নানা রকম পিঠাপুলি। খেজুরের রস দিয়েও পিঠাপুলি খাওয়া হয়। এসময় ভাপা পিঠাও তৈরি করা হয়।

আচ্ছা। দিদা, ভাপা পিঠা কীভাবে তৈরি করা হয়?

বল্লাম তো পরে বলব। এখন ল্যাখ…

প্লিজ। দিদা বলো না…

শোন, ভাপা পিঠা তৈরি করা হয় চালের গুঁড়ো আর গুড় দিয়ে। এবং কোরা নারিকেল দিয়ে।

আচ্ছা। দিদা, গুড় কি?

তাও জানিস না? গুড় হচ্ছে আখ কিংবা খেজুরের রস হতে তৈরি করা এক প্রকারের মিষ্টদ্রব্য। তালের রস হতেও গুড় তৈরি করা হয়। আখ, খেজুর এবং তাল গাছের রস ঘন করে পাক দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়।

আচ্ছা। দিদা, তারপরে কী?

তারপরে ল্যাখ…

হেমন্তকালে গ্রামবাংলায় নানা উৎসব হয়। আয়োজন করা হয় গ্রামীণ মেলার। মেলায় বাউল, সারি, লালন সঙ্গিত গাওয়া হয়। বিভিন্ন ধরনের পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়। এবং লাঠিখেলা, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, খেলনাপাতি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।

দিদা, তোমাদের গ্রামেও কি এসব হয়?

হ্যাঁ, হয়।

আচ্ছা, দিদা, এ সময় আর কী কী হয়?

বলছি তো ল্যাখ…

এ সময় কামিনী, রাজ অশোক, গন্ধরাজ, শিউলি, মল্লিকা, হিমঝুরি, ছাতিম, বকফুলসহ নানা ফুল ফোটে।

দিদা, আর কী কী?

এগুলো লিখেছিস?

হ্যাঁ, দিদা। লিখেছি।

আচ্ছা। ল্যাখ…

এ সময় দেশের বিলে-ঝিলে, হাওরে-বাঁওড়ে দেখা মেলে নানা প্রজাতির পাখির। এগুলো সাইবেরিয়া থেকে আমাদের দেশে চলে আসতে শুরু করে হেমন্তকালে। এ পাখিগুলোকে কুটুমপাখি বলা হয়।

আচ্ছা, দিদা। এ পাখিগুলো আমাদের দেশে আসে কেন?

জানিস না? সাইবেরিয়ায় এ সময় প্রচ- শীত পড়ে। হিম শীতল। পাখিগুলো এত্ত ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। তাই তারা বাংলাদেশে চলে আসে।

আচ্ছা, দিদা। আর কিছু হয়?

হয় তো। অনেক কিছু হয়।

এ সময় অনেক সবজিও চাষ করা হয়। টমেটো, আলু, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, শিম, কদু, মূলা, ঢেঁড়স, শসা ইত্যাদি সবজি চাষ করা হয়।

দিদা, এসব সবজি খেলে তো আমাদের শরীরের পুষ্টি যোগায়।

হ্যাঁ, মুন।

আচ্ছা। দিদা, এই যে হেমন্তের এত্ত কিছু বর্ণনা করলে। আমরা তো এর কিছুই দেখতে পাই না।

হ্যাঁ, মুন। তোমরা তো শহরে থাকো এজন্যই। আমরা তো গ্রামে থাকি তাই আমারা ঋতুর পরিবর্তন টের পাই। এবং বাস্তবে তা দেখি, উপলব্ধি করি। আর জানিস? হেমন্তকে তার এই রূপ, লাবণ্যের কারণেই ঋতুরানিও বলা হয়।

তোর স্কুল বন্ধ হলে গ্রামে আসিস। তোকে সবই বলব। নিজ চক্ষে দেখবে গ্রামের চিরায়ত সৌন্দর্য।

আচ্ছা, দিদা। সামনে আমার বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হলেই আমি ছুটি পাবো। আব্বুকেও বলব যেমন করে হোক অফিস থেকে ছুটি নিতে। আমরা ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে গ্রামে আসব।

এ সময় তোমার কাছ থেকে সব শুনবো। পুরো গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখব।

আচ্ছা, বোন। এই প্রথম তুই গ্রামে আসবি। শুনে খুশি হলাম। তোর দাদু এলে তাঁকেও বলব। তুই ভালো থাকিস।

ওকে, দিদা। উম্ম…..মা!

 

পথিকবাবু তার বিড়ালছানা

পবিত্র মহন্ত জীবন

আমার ছেলে পথিকবাবু পুষে বিড়ালছানা

মাছ মাংস পোলাও ভাত খেতে দেয় খানা!

পথিকবাবু আদর করে নাম রেখেছে পিষি

সারাদিন দুষ্টুমিতে দু’জনেই তাই খুশি!

পুকুরপাড়ে গোসল করে দুষ্টু বিড়ালছানা

তা-ই দেখে পথিকবাবু করছে তাকে মানা?

গোসল সেরে এঘর-ওঘর করছে ছুটাছুটি –

পেটভরে বিড়ালছানা খাচ্ছে শুকনো রুটি,

পথিকবাবু রাগ করেনি দিচ্ছে আরো রুটি

বাহ্! বাহ্বা! দেখ ওদের ভালোবাসার জুটি!