স্কুলের নাম পাখির ডাক

এমরান চৌধুরী »

গোলাম সামদানী। কেশুয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেড স্যার। তিনি এই স্কুলে যেদিন প্রথম আসেন তাঁর মনে হয়েছিল এটি একটি কৃষিখামার। যোগদান করতে আসার সময় স্কুলের সামনে এসে তিনি থমকে দাঁড়ান। একটু দূরে খেলছিল একটি ছেলে । ইশারায় তিনি ছেলেটিকে কাছে ডাকলেন। ছেলেটি কাছে আসতেই বললেন, কেশুয়ারা প্রাইমারি স্কুলটা কোনদিকে বাবা?
ছেলেটি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দু’ মিনিট চুপ থাকল। তারপর বলল, আপনি কী পাখির ডাক স্কুলের কথা বলছেন!
সামদানি স্যার চমকে ওঠলেন। বললেন, পাখির ডাক নামে স্কুল হয় বাবা!
এখানে যে স্কুলটা আছে তাকে এই নামে ডাকে সবাই তাই, বলে একটা পথ দেখিয়ে দিল ছেলেটা।
স্কুলের গেইট দেখে চেনা যাচ্ছিল না এটা স্কুল না খামারবাড়ি! স্কুলের আঙিনায় গ্রামের কৃষকদের খড়ের স্তূপ। একটু দূরে গোয়ালঘরের মতো গরু বাঁধা। ঢুকতেই বাতাসের সাথে ভেসে আসছিল গোমূত্রের ঘ্রাণ। আর স্কুলের প্রবেশপথে পড়শির রোদে শুকাতে থাকা লাকড়ি। লম্বা টিনের চালের ওপরে কাকের, ছোটাছুটি আর দাপাদাপি।
স্কুলটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বছর দশেক আগে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা হয়েছে স্কুলটি যাতে সরকারি হয়। কিন্তু প্রতিবারই পরিদর্শক এসে অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যান।। একেতো স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। তার ওপর স্কুলের পারিপার্শ্বিক পরিচ্ছন্নতার যে হাল! এ অবস্থায় কোনো পরিদর্শকের পক্ষে স্কুল সরকারিকরণের সুপারিশ করা সম্ভব ছিল না।
ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির আত্মীয় হন এই সামদানি স্যার। এই গ্রামে একটাই মাত্র স্কুল। শক্ত করে কেউ হাল না ধরলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা সব উচ্ছন্নে যাবে। তাই সভাপতি সাহেব অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সামদানি স্যারকে রাজি করান এই স্কুলটা দাঁড় করিয়ে দিতে। আলোর মানুষ আলো না জ্বালিয়ে পারেন না। এর আগে তিনি শহরের একটা কেজি স্কুলের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
স্কুলে যোগদানের পরদিনই তিনি স্থানীয় মেম্বার, জমিদাতা এবং শিক্ষকদের নিয়ে বসলেন। সেদিন ছিল জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ। সাত শব্দটা অনেকের কাছে লাকি। তিনিও ভাবলেন ভালো কাজে এক সেকেন্ডও অনেক মূল্যবান। তিনি মেম্বারের কাছে স্কুলের যতটুকু এলাকা তা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে স্কুলকে বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ করেন। সে সঙ্গে সমস্ত আগাছা পরিষ্কার এবং চারিদিকে খুঁটি গেঁড়ে সীমানা নির্দিষ্ট করে দিতে বলা হয়। জমিদাতা এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্কুলের ফটক, সাইনবোর্ড এবং টিন শেড স্কুলের যে সব টিন মরচে ধরেছে কিংবা ফুটো হয়েছে তা যেন বদলে নতুন টিন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
স্কুলে শিক্ষক ছিল চার জন। দু’জন পুরুষ, দু’জন মহিলা। একজন সহকারী শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁকে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদায়ন করেন। সামদানি স্যার আরও একজন সহকারী শিক্ষিকা নিয়োগ দিলেন। তিনি পাঁচজন টিচারকে ক্লাসগুলো ভাগ করে দিলেন। বছরের শুরুতে পাঁচ ক্লাস মিলে ছাত্র-ছাত্রী ছিল দেড় শ’র মতো। তিনি তা আগামী এক বছরের মধ্যে আড়াই শতে উন্নীত করার পরিকল্পনা করলেন। এজন্য তিনি প্রতিদিন একজন টিচার, একজন ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নিয়ে বাড়ি বাড়ি ছাত্র সংগ্রহের কাজ শুরু করলেন। ছাত্র সংগ্রহের কাজটি শুরু করেন খুব দ্রুত। কারণ নতুন বছরের শুরুতে তা না করলে ছেলেমেয়েরা পার্শ্ববর্তী গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া স্কুলের যে নাম ছড়িয়েছে তাতে কোনো শিক্ষিত অভিভাবক এই স্কুলে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাতে আগ্রহী হবেন না। এসব বিষয় মাথায় রেখে তিনি নেমে পড়লেন ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহে।
দেখতে না দেখতে স্কুলের চেহারা পাল্টে গেল। রঙিন কালিতে লেখা সাইনবোর্ড উঠল- কেশুয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয়। টিনের ওপর পড়ল নতুন রঙ। সূর্যের আলোতে টিনগুলোকে আলোর ফোয়ারা বলে মনে হতে লাগল। প্রতি ক্লাসে কম বেশি ৪০ জনের মতো করে ছাত্র-ছাত্রী হলো। এই স্কুলে প্রথম বারের মতো পালিত হলো শহিদ দিবস। স্থানীয় চেয়ারম্যান প্রধান অতিথি হিসেবে থেকে শিক্ষার্থীদের ভাষার লড়াইয়ে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের স্মৃতিচারণ করেন। এভাবে স্বাধীনতা দিবস, নববর্ষ, বিজয়দিবস, স্কুলের বার্ষিক প্রতিযোগিতায় মুখর হয়ে ওঠল কেশুয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এভাবে একটা বছর কেটে গেল। বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন দেখা গেল চতুর্থ শ্রেণির একজন ছাত্র এবং দ্বিতীয় শ্রেণির দুইজন ছাড়া সবাই পাশ করেছে। এই অভূতপূর্ব ফলাফলে প্রধান শিক্ষক তাঁর সহকর্মীদের প্রশংসা করলেন। গত দশ বছরের মধ্যে এই প্রথমবার স্কুলটিতে প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী পাশ করায় গ্রামের লোকেরা খুব আনন্দিত। উৎফুল্ল স্কুলের টিচাররাও। এ আনন্দকে শতভাগ রূপ দিতে সামদানি স্যার চতুর্থ শ্রেণিতে ফেল করা ছাত্রটিকে এবং দ্বিতীয় শ্রেণির দুইজন ছাত্রীকে বিশেষ বিবেচনায় প্রমোশন দিয়ে দিলেন।
মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়। সামদানি স্যার তাঁর সহকর্মীদের একটি পত্র পড়ে শোনালেন। এ মাসের বাইশ তারিখে এই স্কুল পরিদর্শনে আসছেন একজন সিনিয়র স্কুল পরিদর্শক। তিনি তাঁর সহকর্মীদের জানালেন এই পরিদর্শনের ওপর নির্ভর করছে এই স্কুল সরকারিকরণ। সুতরাং সামনে যে কয়টা দিন আছে তার মধ্যে আমাদের সব প্রস্তুতি নিতে হবে। কোথাও যেন কোন ফাঁকফোকর না থাকে। এই নিয়ে সামদানি স্যার তাঁর সহকর্মীদের তিনটি গাইড লাইন দিলেন। নাম্বার ওয়ান, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। নাম্বার টু, ঐ দিনের নির্ধারিত পাঠ সব ছাত্র-ছাত্রী যাতে পারে তার জন্যে পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়া। নাম্বার ত্রি, সাধারণ জ্ঞান তথা বাংলাদেশের জাতীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা রাখা।
মার্চ মাসের বাইশ তারিখ। সবাই প্রস্তুত সিনিয়র পরিদর্শককে অভ্যর্থনা জানাতে। বেলা এগারোটার দিকে উপস্থিত হলেন সিনিয়র স্কুল পরিদর্শক মোবারক আলী। তিনি প্রধান শিক্ষকের কক্ষে না গিয়ে সরাসরি ঢুকলেন তৃতীয় শ্রেণিতে। দেখতে পেয়ে ছুটে এলেন সামদানি স্যার। অন্যান্য টিচাররাও এসে সালাম দিলেন সিনিয়র স্কুল পরিদর্শককে।
আপনার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছাত্র-ছাত্রী কোন ক্লাসে বেশি? সামদানি স্যারের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন স্কুল পরিদর্শক।
সব ক্লাসের প্রতি আমরা সমান যতœ নিয়েছি স্যার। আশা করছি সবাই ভালো করবে।
তাই নাকি!
এটা আমার বিশ্বাস। তাহলে চলুন ক্লাস ফাইভে যাওয়া যাক। এ কথা বলেই পরিদর্শক হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁকে অনুসরণ করলেন সামদানি স্যার ও অন্য টিচাররা।
পরিদর্শক ক্লাসে ঢুকতেই সব শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
স্কুল পরিদর্শক সালামের জবাব দিয়েই কেউ কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বললেন, আড়াই নম্বর কম পাওয়া ছাত্রটি কে?
আচমকা প্রশ্নে সামদানি স্যার বিস্মিত হলেন। ভাবলেন আড়াই নম্বর কম পাওয়া ছাত্রটিকে প্রমোশন দিয়ে তিনি কী ঠিক করেননি? অন্য টিচারদের গলা শুকিয়ে কাঠ হওয়ার জো। বিশেষ করে যে শিক্ষক খাতা দেখেছেন তাঁর বুকে ধুকপুক শুরু হলো।
মাঝের সারিতে বসা পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো একটি ছেলে বলল, আমি স্যার।
আপনি!
জি, স্যার।
সম্মানসূচক বাক্যচয়নে টিচারদের বিস্ময়ের পারদ ক্রমশ ওপরে ওঠতে থাকল। তাঁরা তাঁদের জীবনে এ প্রথম একজন ছাত্রকে কোনো পরিদর্শক আপনি বলতে দেখলেন। অন্যদিকে ছেলেটি যখন নিজের পরিচয় দিচ্ছিল তখন তার চোখে ঠিকরে পড়ছিল দৃঢ়তার আলো। যেখানে পরিদর্শকের প্রশ্নে একজন ছাত্র ঠির ঠির করে কাঁপে সেখানে তার সাহসিকতায় প্রাণ পেলেন সামদানি স্যার।
আপনি তো আড়াই নম্বরের জন্য ফেল করেছিলেন!
জি, স্যার।
এখন আপনাকেই পাশ করাতে হবে এই স্কুলকে। দিতে হবে আড়াইটা প্রশ্নের উত্তর। যদি ঠিকঠাক মতো দিতে পারেন, তাহলে আপনার স্কুল পাশ। নইলে ফেল। আমি আপনাকে বুঝাইতে পারছি।
জি, স্যার।
মোট নম্বরও আড়াই। প্রথম সঠিক উত্তরের জন্য আধা নম্বর, পরের দুটোর জন্য এক নম্বর করে
পাবেন।
ইউ আর রেডি!
ইয়েস স্যার।
আপনার বাম হাতে বোতামের মতো একটা দাগ আছে, বলুন দাগটা কিসের?
টিকার।
গুড। এটা কিসের টিকা?
যক্ষ্মা রোগের।
ভেরি গুড।
টিকাটার নাম?
বিসিজি।
ভেরি ভেরি গুড।
পরিদর্শকের ভেরি ভেরি গুড শব্দে পুরো ক্লাস প্রচ- করতালিতে মুখর হয়ে ওঠল। করতালি থামতেই পরিদর্শক বললেন, জীবনে ফেল না করলে কেউ সাকসেস হয় না। আর এই ছেলেটা ফেল করেছে বলেই আপনারা চিনলেন, ছেলেটা কত মেধাবী। এই ক্লাসে আরো একান্ন জন শিক্ষার্থী আছে সবার প্রগ্রেসিভ রিপোর্ট আমি শিক্ষা অফিসে দেখেছি। মাত্র আড়াই নম্বর বেশি পেলে ছেলেটা হতো ফাস্ট বয়। আপনারা অংক, ইংরেজি, বিজ্ঞান এসব বিষয়ে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনায় নেননি। যা নেওয়া উচিত ছিল। ভবিষ্যতে এ দিকটার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবেন। বলেই পরিদর্শক আর কোনো ক্লাসে না গিয়ে সোজা গিয়ে উঠলেন তাঁকে বহনকারী গাড়িতে।
আর এদিকে ক্লাস ফাইভের ছাত্ররা ফেল করা ছাত্রটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে মাঠের এ মাথা থেকে ও মাথা মাথায় তুলে নাচতে লাগল।