সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরের বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠবে মাতারবাড়ি

  • একান্ত সাক্ষাৎকার: জাফর আলম #

  • চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) #

  • ২০২৫ সালে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং #

মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জাহাজ ভেড়ানোর কথা ওঠে ২০১৫ সালে। ২০১৬ সালে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় সার্ভে এবং ২০১৭ সালে মাতারবাড়িতে পৃথক বন্দর হিসেবে সমীক্ষার পর ২০২০ সালে এসে নিয়োগ দেয়া হয় পরামর্শক। এভাবে দ্রুত গতিতে প্রকল্পটি এগিয়ে আনতে যিনি সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করছেন তিনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (পরিকল্পনা ও প্রশাসন) জাফর আলম। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়ে জাফর আলমের সাথে কথা বলেন সুপ্রভাত বাংলাদেশের প্রধান প্রতিবেদক ভূঁইয়া নজরুল।

সুপ্রভাত বাংলাদেশ: মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠছিল। সেই অনুযায়ী কাজও শুরু হয়।  এক্ষেত্রে বন্দর গড়ে তোলার বিষয়টি কখন আলোচনায় আসে?

জাফর আলম: কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অধীনে কয়লাবাহী জাহাজ ভেড়াতে জেটির প্রয়োজন। আর জেটিতে সাগর থেকে জাহাজ আসার জন্য প্রয়োজন চ্যানেল নির্মাণ। সেই জাহাজ অপারেশনের বিষয় রয়েছে। জাহাজ ভেড়াতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের অধীনে ব্রেক ওয়াটার, চ্যানেল ও জেটি নির্মাণ করলেও বন্দরের প্রয়োজন রয়েছে। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ২০১৬ সালের সার্ভেতে তা উঠে আসে। সেই সার্ভে রিপোর্টে এখানে একটি বন্দর গড়ে তোলার বিষয়টি বলা হয়। পরবর্তীতে বন্দর গড়ে তোলার জন্য ২০১৭ সালে একটি স্টাডি হয় এবং সেই স্টাডি রিপোর্টে কীভাবে বন্দর গড়ে তোলা সম্ভব এবং তা বাণিজ্যিকভাবে কতটুকু সফল হবে সেগুলোও উঠে আসে। আর এরই ফলশ্রুতিতে মাতারবাড়ি বন্দর গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু হয়।

সুপ্রভাত : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য একটি এবং সাধারণ বন্দর হিসেবে হিসেবে একটি- তাহলে মাতারবাড়ি কি দুটো পার্ট?

জাফর আলম: আপাতদৃষ্টিতে দুটো পার্ট মনে হতে পারে। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে জাহাজ ভিড়তে বন্দর লাগবেই। তবে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ২৫০ মিটার চওড়া ও ১৮.৫ মিটার ড্রাফটের চ্যানেল নির্মাণ শেষ। নির্মাণ হয়ে গেছে ব্রেক ওয়াটারও। এই চ্যানেলে আগামী মাসেই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের অধীনে নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে জাহাজ ভিড়বে। সেই হিসেবে বন্দর নির্মাণের কাজ অনেকাংশে শেষ। এখন শুধু চ্যানেলটি আরো ১০০ মিটার চওড়া করা, টার্মিনাল নির্মাণ এবং অবকাঠামো কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে বন্দর প্রকল্পের আওতায়।

সুপ্রভাত: তাহলে কয়লা বিদ্যুতের জাহাজ ভেড়ানোর ওপর ভর করে গড়ে উঠছে মাতারবাড়ি বন্দর-

জাফর আলম: বিষয়টি এমন নয়। কয়লা বিদ্যুতের জন্য ওই এলাকাটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর তা করতে গিয়ে স্টাডিতে এখানে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠতে পারে বলে জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) প্রতিবেদনে উঠে আসে। তখন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশে ২৮৮ একর জমিতে প্রথম পর্যায়ে মাতারবাড়ি বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়। ইতিমধ্যে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ৯৩৭ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে।

সুপ্রভাত : সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর হওয়ার কথা ছিল। মাতারবাড়ি কি সোনাদিয়ার বিকল্প?

জাফর আলম: জাইকার একটা স্টাডি ছিল সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর করার বিষয়ে। তবে এখন যেহেতু মাতারবাড়িতে সমুদ্র বন্দরের সব সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে তাই এখন আর সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রয়োজন নেই। মাতারবাড়ি বন্দরে ১৮.৫ মিটার ড্রাফট থাকছে এবং যেকোনো দৈর্ঘ্যরে জাহাজ এখানে ভিড়তে পারবে। মাতারবাড়ি থেকে চট্টগ্রাম বন্দর, বে টার্মিনাল, পায়রা, মোংলাসহ ভারতের বন্দরগুলোতে ছোটো জাহাজে করে পণ্য পরিবহন করা যাবে।

এছাড়া জাইকার স্টাডিতে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এলাকাটিকে বাংলাদেশের গ্রোথ জেনারেশন বেল্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই হিসেবে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে জাপান সফরে গেলে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গোপসাগরের এই এলাকাকে বিগ বি ( Bay of Bengal Industrial Growth)  হিসেবে উল্লেখ করেন। বিগ বি মূলত তিনটি পিলারের উপর। এগুলো হলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেড, এনার্জি ( কয়লা, এলএনজি ও এলপিজি) এবং ট্রান্সপোর্টেশন। জাপান এসব খাতে উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন। আর সেই আশ্বাসের ভিত্তিতেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং পরবর্তীতে মাতারবাড়ি বন্দরে জাপানি বিনিয়োগ এসেছে। একইসাথে ট্রান্সপোর্টেশন খাতেও জাপান বিনিয়োগ করছে।

সুপ্রভাত: মাতারবাড়ি বন্দরে জাপানি বিনিয়োগের পরিমাণ কতটা?

জাফর আলম : মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের মোট বাজেট ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এরমধ্যে জাপান অর্থায়ন করছে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, বাংলাদেশ সরকার ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।

সুপ্রভাত : কবে নাগাদ এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে?

জাফর আলম: ইতোমধ্যে জাপানি প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোয়েই-কে প্রকল্পের জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আগামী আট মাসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা দেবে। সেই রিপোর্টে মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের ডিটেইলড স্টাডি থাকবে। আর স্টাডির ভিত্তিতে দরপত্র ডকুমেন্ট তৈরির কাজেও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি সাপোর্ট দেবে। একইসাথে টার্মিনালের নির্মাণ কার্যক্রম সঠিকভাবে হচ্ছে কি-না সেই কার্যক্রমও মনিটর করবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি। যদিও ২০২৬ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে তারপরও আমরা ২০২৫ সালে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের জন্য মাতারবাড়িকে প্রস্তুত করতে পারবো বলে আশা করছি।

সুপ্রভাত :  এই সময়ের মধ্যে কি সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করা সম্ভব?

জাফর আলম : একটি বন্দরের পশ্চাদভূমির কানেকটিভিটির জন্য থ্রি আর (জ) খুবই গুরুত্বপূর্র্ণ। এই থ্রি আরে রয়েছে রিভার (নদী), রোড ও রেলওয়ে। ২০২৫ মধ্যে বন্দর প্রস্তত হয়ে যাবার পর আমরা নদীপথে চট্টগ্রাম বন্দর, পায়রা বন্দর, মোংলা বন্দরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করতে পারবো। তবে সড়ক ও রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি হতে ২০২৬ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

সুপ্রভাত : সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক কীভাবে স্থাপিত হবে?

জাফর আলম : দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে। সেই রেললাইন প্রকল্পের চকরিয়া থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত প্রায় ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রেললাইন নির্মাণ করা হবে। একইসাথে চকরিয়া থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে। সেই এক্সপ্রেসওয়ের উপর দিয়ে বন্দরের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি এবং নিচ দিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের গাড়ি চলাচল করবে।

সুপ্রভাত : ব্যবসায়ীদের অনেকে বলছে মাতারবাড়ি বন্দর সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে সিঙ্গাপুর ও কলম্বোকে অগ্রাধিকার দিতে পারে ব্যবসায়ীরা। এছাড়া তাদের কাছে বে টার্মিনাল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্র্ণ। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করছেন?

জাফর আলম : গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে কাজ করবে মাতারবাড়ি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ পণ্য আসে চীন থেকে। মাদার ভেসেলে (বড় জাহাজ) চীন থেকে পণ্যগুলো এখন সিঙ্গাপুর আসে, সিঙ্গাপুর থেকে তা চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এখন যদি পণ্যগুলো চীন থেকে সরাসরি মাতারবাড়িতে আসে এবং সেখান থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কিংবা দেশের অন্যান্য এলাকায় লাইটার জাহাজে (ছোটো জাহাজ) পণ্য নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এতে কমপক্ষে দুই দিন সময় সাশ্রয় হবে।

অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিপণ্য বেশিরভাগ যায় ইউরোপে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম থেকে পণ্য প্রথমে কলম্বো বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে ইউরোপের বন্দরগুলোতে নিয়ে যায় মাদারভেসেলে করে।

আমরা সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর বিকল্প হিসেবে মাতারবাড়িকে কাজে লাগাতে চাই। আমাদের পরিচালনা ব্যয় সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর তুলনায় সাশ্রয়ী হবে এবং সময়ও বাঁচবে। তাই মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে গড়ে উঠবে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী বন্দরগুলোর জন্য। বে টার্মিনালের সাথে মাতারবাড়ির কোনো তুলনা হতে পারে না। মাতারবাড়ি থেকে পণ্য নিয়ে জাহাজগুলো বে টার্মিনালেও আসবে।

সুপ্রভাত : তাহলে দেখা যাচ্ছে মাতারবাড়ির সাথে দেশের অন্যান্য বন্দরগুলোর সাথে ফিডার রুট (ছোটো জাহাজ চলাচলের রুট) বেড়ে যাবে-

জাফর আলম: মাতারবাড়ির সাথে বঙ্গোপসাগরের উপকূলের বন্দরগুলোর মধ্যে ফিডার সার্ভিস বাড়বে। একইসাথে ভারতের বন্দরগুলোও মাতারবাড়ি থেকে গভীর সমুদ্র বন্দরের সুবিধা পাবে। নৌ পথে তারাও পণ্য সরবরাহ করতে পারবে।