‘সাদাছড়ির উন্নতি, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অগ্রগতি’

মো. আবুল হাসেম খান »

সারা বিশ্বে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সক্ষমতা অর্জন করার উপকরণটি হচ্ছে- সাদাছড়ি। সাদাছড়ি ব্যবহার করে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিরাপদে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় (কর্মস্থল, স্কুল, প্রতিবেশীর বাড়ি) চলাফেরা করতে পারে। বিশেষ পদ্ধতি (ব্রেইল) ব্যবহার করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে তারা সমান দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হেলেন কেলার ছিলেন একজন শ্রবন – দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী (ফবধভ-নষরহফহবংং) ব্যক্তি।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের জীবনে এই সহায়ক উপকরণটি কতটুকু ভুমিকা রাখছে, তা জনসাধারনকে জানাতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিশ্বব্যাপী সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস উদযাপন করা হয়। একজন গাড়ি চালক সাদাছড়ি হাতে রাস্তা পার হতে দেখলে হর্ণ না বাজিয়ে ৫ (পাঁচ) ফুট দূরত্বে গাড়ী থামিয়ে তাকে নিরাপদে রাস্তা পার হতে সুযোগ দেবেন। এভাবে আমরা সাদাছড়ি ব্যবহারকারি ব্যক্তির প্রতি আমাদের করণীয় সম্পর্কে এই দিবসকে কেন্দ্র করে সচেতনতামুলক কার্যক্রম পরিচালনা করব। চট্টগ্রামে সরকারি -বেসরকারি সংস্থাসমূহ যৌথভাবে প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর র‌্যালি, আলোচনাসভা, সাদাছড়ি বিতরণ ইত্যাদি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জনসাধারনের মাঝে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে দিবসটি উদযাপন করে আসছে। ফলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে সমাজে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী তৈরী হচ্ছে।
এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে Ñ “সাদাছড়ির উন্নতি, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অগ্রগতি।”
আগের সাধারণ সাদা ছড়িটিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে ডিজিটাল প্রযুক্তিটি সামনের বিভিন্ন বাধা সম্পর্কে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সংকেত প্রদান করতে পারে। এর ফলে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সামনের দেয়াল, কোন ব্যক্তি, বিভিন্ন গর্ত ইত্যাদি সম্পর্কে ত্বরিৎ সংকেত পেয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে নিরাপদে চলাচল করতে পারে। আমাদের মত দরিদ্র দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তিসম্পন্ন এই সাদাছড়ি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা প্রয়োজন।
১৯৬৪ সালের ৬ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস উদযাপন করার জন্য একটি বিল পাশ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের সক্ষমতাগুলো সকলের সামনে তুলে আনা এবং অন্যান্য নাগরিকদের সাথে সমতার ভিত্তিতে জীবন-যাপন করার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য এ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস উদযাপনের মাধ্যমে সকলকে জানানো হয় যে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা কি এবং কিভাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গ জীবন-যাপন করেন, তারা তাদের সক্ষমতা এবং সফলতার মাধ্যমে সমাজের মূল¯্রােতধারায় কি অবদান রাখছেন এ সকল বিষয় সকলের সামনে তুলে ধরা হয়। ১৮৯৪ সালে কলকাতায় অন্ধ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৯৩৫ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম বঙ্গীয় বধির সংস্থা গঠিত হয়। ১৯৫৭ সালে রোটারী ক্লাবের উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৬২ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর চারটি বিভাগে ৮টি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও বাক-শ্রবণ বিদ্যালয় চালু করে। ১৯৭৪ সালে ৪৭টি সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় চালু হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের শিক্ষাক্ষেত্রে বাধাসমূহ (বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল বই সরবরাহ, টকিং সফটওয়ার যুক্ত বই সহজলভ্য করা, পরীক্ষায় শ্রুতি লেখক নিয়োগ, শব্দযুক্ত ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থা স্থাপন ইত্যাদি) দূর করার জন্য সরকারকে বিভিন্ন উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার দশম শ্রেণী পর্যন্ত তাদের জন্য ব্রেইল বই সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে।
বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাস্কর ভট্টাচার্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইটি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দক্ষতার সাথে কাজ করে আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষে ‘ইউনাইট্ থিয়েটার ফর সোশাল অ্যাক্শন্ (উৎস/টঞঝঅ)’ এর থিয়েটার ইউনিট এর সাথে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। উৎসতে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি উৎস এর আওতায় বিশেষায়িত উন্নয়ন ইউনিট ‘চিটাগাং কম্পিউটারাইজড ব্রেইল প্রোডাকশন সেন্টার (সিসিবিপিসি)’ এবং ‘ দি বাংলাদেশ ব্রেইল লাইব্রেরী (বিবিএল)’ গড়ে তুলতে রেখেছিলেন অগ্রগণ্য ভূমিকা। উৎস পরিবারের পক্ষ থেকে আজকের এই বিশেষ দিবসে তার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি। তাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে এ বছরের প্রতিপাদ্যঃ “সাদাছড়ির উন্নতি, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির অগ্রগতি”- এর ব্যাপক প্রচার চালিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। তবেই একটা সমতাভিত্তিক সমাজ তৈরি হবে। আসুন সকলে মিলে দিবস উদযাপনে অংশ নিয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি আমাদের করণীয় পালন করে একজন সচেতন নাগরিকের ভুমিকা রাখি। তবেই দিবস উদযাপন সার্থক হবে।
লেখক : উন্নয়নকর্মী