সাংবাদিকতায় আমার প্রথম সম্পাদক

মিন্টু চৌধুরী <<
ইরাকে মার্কিন হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে পাশ্চাত্য পোশাক ত্যাগ করে সম্পূর্ণ সাদা পোশাকে একজন শুভ্র ব্যক্তি ঢাকার রাস্তায় নেমেছেন। সংবাদপত্রগুলোতে সেসময় প্রকাশিত এমন সংবাদে চোখ আটকে গিয়েছিল। পরে জানতে পারি তিনি সাংবাদিক, লেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ।
সেসময় ইরাকে হামলার বিরুদ্ধে বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায়সব কর্মসূচিতে একজন ব্যক্তি হিসেবে অংশ নিতেন নিয়মিতই। একটি জাতীয় দৈনিকে তাঁর ‘সহজিয়া কড়চা’ শিরোনামে নিয়মিত কলাম পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। সাদা পোশাকের প্রতিবাদী মানুষটির প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা সেসময় থেকে। পরবর্তীতে বাম ছাত্র সংগঠনের কয়েকটি কর্মসূচিতে তিনি চট্টগ্রামে অংশ নেয়ার ফলে তাকে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্যও হয়।
কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রামের ‘দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। এ দৈনিকটির মধ্য দিয়ে আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু এবং তিনিই আমার প্রথম সম্পাদক। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের একজন অকুতোভয় সেনানি, গবেষক-সাংবাদিক আবুল মকসুদকে সম্পাদক হিসেবে পেয়ে গৌরবান্বিত বোধ করেছিলাম। শুরুর দিকে পত্রিকাটির পক্ষ থেকে আমাদের কর্মশালা করানো হয়। সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদ আমাদের সাংবাদিকতার নীতি, নৈতিকতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আগে থেকে কিছুটা পরিচিত হওয়ায় তাঁকে পেয়ে অন্যদের চেয়ে আমার আনন্দটা মনে মনে ছিল কিছুটা বেশি।
সুপ্রভাত বাংলাদেশ কয়েকমাস ‘ইন হাউজ’ কাজ করে ডামি পত্রিকা প্রকাশ হতো। তখন মাসের একটা নির্দিষ্ট সময়ে চট্টগ্রাম আসতেন সম্পাদক আবুল মকসুদ। চট্টগ্রামের জামালখানে তাঁর জন্য বরাদ্দ করা একটি বাসায় থাকতেন তিনি। তিনি প্রায় প্রতিদিনই অফিসে আসতেন। বার্তা কক্ষে বসে কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে আলাপ করে বিভিন্ন বিষয় জানার চেষ্টা করতেন এবং পরামর্শও দিতেন। সেসময় তিনি সাংবাদিকতার বাইরেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন, এতে ঋদ্ধ হতেন বার্তাকক্ষে কর্মরত সাংবাদিকরা। আগাগোড়া সাদা পোশাকের মানুষ যখন সুপ্রভাতের বার্তাকক্ষে প্রবেশ করতেন তখন অন্যরকম এক আবহ ছড়িয়ে পড়ত।
সুপ্রভাতে কাজ করার সময়ে কয়েকবার সম্পাদকের কক্ষে ডাকও পড়েছিল আমার। প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে সৈয়দ আবুল মকসুদ ডেকে জিজ্ঞেস করতেন চট্টগ্রামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর সেই সময়কার অবস্থা। বিভিন্ন সময়ে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি তাঁর বিনয় এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সবসময়ই ন্যায়ের পক্ষে আপোষহীন, গণমানুষের অধিকার আদায় ও সমাজ প্রগতির লড়াইয়ের সম্মুখযোদ্ধা সৈয়দ আবুল মকসুদ নিয়মিতই কলাম লিখতেন।
তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে গবেষণা করে গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। সম্পাদক হিসেবে চট্টগ্রাম এলেও তার লেখা ও গবেষণা থেমে থাকেনি। চট্টগ্রামের জামালখানে তাঁর জন্য বরাদ্দ করা বাসায় কয়েকবার ডাক পড়েছিল আমার। তাঁর করা গবেষণা কাজের অনুলিখনের কাজও করেছিলাম কয়েকদিন। তখন দেখেছি একজন বড়মাপের মানুষ হবার পরও কাজের প্রতি নিষ্ঠা, ন্যায়ের প্রতি অবিচল এবং মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। তার অধীনে একজন ক্ষুদ্র সংবাদকর্মী হওয়ার পরও আমাদের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল অবারিত।
তিনি সবসময়ই নিচুস্বরে পরিমিত কথা বলতেন। কখনও কারও সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখি নি। আমার মতো নগন্য সাংবাদিকের ভাগ্য চাকরি জীবনের প্রথম সম্পাদক হিসেবে পেয়েছি সৈয়দ আবুল মকসুদ-এর মতো বড় একজন মানুষকে। মানবতাবাদকে তিনি জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সমাজের নানা অসংগতি নিয়ে রাস্তায় নামতেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নিতেন। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর চলে যাওয়া আমাদের সমাজের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। একজন সাংবাদিক হিসেবে, গবেষক হিসেবে, লেখক হিসেবে তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদের প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক: সিনিয়র করেসপনডেন্ট, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম