শেফালীর সুরের সৌরভ

নাসির উদ্দিন হায়দার »

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান নিয়ে শুরু থেকেই একশ্রেণীর মানুষের নাক সিঁটকানো স্বভাব ছিল। শিক্ষিত সমাজের একটি অংশও আঞ্চলিক গানকে তাদের গান মনে করতেন না, তবে মূলধারার বাইরের কিছু শিল্পীর আঞ্চলিক গানে অশ্লীলতা যে একদম ছিল না তাও নয়।
ফলে আঞ্চলিক গানের সমৃদ্ধি অর্জনে চট্টগ্রামের একদল শিল্পীকে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। নানা বৈরিতা জয় করেই কিন্তু চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান গণমানুষের মন-জয় করেছে, চট্টগ্রামের গ-ি ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে স্থান করে নিয়েছে। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব অবশ্যই শিল্পী শেফালী ঘোষের। বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ার গ্রাম্য কিশোরী শেফালী গানের ফুল হয়ে ফুটেছিলেন নিজের প্রতিভা ও সীমাহীন পরিশ্রমের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফুজ্জামান, সংগীতজ্ঞ আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার ও ননীগোপাল দত্তের মতো মানুষগুলো শেফালীর সৌরভ ছড়ানোতে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষ, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের অবিস্মরণীয় জুটি। প্রায় তিন যুগ স্থায়ী কালজয়ী এই জুটি অসংখ্য চিরসবুজ গান উপহার দিয়েছে। একটি অঞ্চলের (চট্টগ্রামের) গানকে কণ্ঠে ধারণ করে সংগীত জগতের কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও -শেফালী ঘোষ, আঞ্চলিক গানকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন তারা। ‘বন্ধু আঁর দুয়ারদি যঅ’, ‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু’, ‘বানুরে জি জি…’, ‘আঁরে হত ভারাইবা’, ‘নঅ যাইও নঅ যাইও’, ‘রেঙ্গুইন্যা সুন্দরী’, ‘বাইক্যা টিয়া দে’, ‘আঁর বউয়েরে আঁই কিলাইয়ুম’সহ শ্যাম-শেফালী জুটির অবিস্মরণীয় অসংখ্য গান রয়েছে। তাদের কালোত্তীর্ণ অনেক একক গানও রয়েছে। তবে শ্যামের চেয়ে শেফালীর একক জনপ্রিয় গানের সংখ্যা অনেক বেশি। ২০০৮ সালে সরকার সংগীতে শেফালী ঘোষকে একুশে পদক প্রদান করে।
শেফালী ঘোষের জন্ম ১৯৪১ সালের ১১ জানুয়ারি, বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া গ্রামে। শেফালী পড়াশোনা করেছেন কানুনগোপাড়া মুক্তাকেশী উচ্চবিদ্যালয়ে। ১২ বছর বয়সে গ্রামের বাড়িতে ওস্তাদ তেজেন সেনের কাছে তালিম নিয়েছেন। মূলত বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান করার মধ্য দিয়েই শিল্পী হিসাবে নাম করেন গ্রাম্য বালিকা শেফালী ঘোষ।
শেফালী ঘোষ গান শিখেছেন সংগীতাচার্য জগদানন্দ বড়–য়া, নীরদ বরণ বড়–য়া, মিহির লালা, গোপাল কৃঞ্চ চৌধুরী, হেনরী গিলবার্ট, এমএন আখতার, আবদুল গফুর হালী, সৈয়দ আনোয়ার মুফতি, আনোয়ার পারভেজ, সৈয়দ মহিউদ্দিন ও এম এ কাশেমের কাছে। ১৯৬৩ বা ৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম বেতারে তালিকাভুক্ত হন। বেতারে তার প্রথম গান ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে…।’
শেফালী ঘোষের কণ্ঠে প্রথম রেকর্ড করা গান ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা…।’ মোহল লাল দাশের কথা ও সুরে সেই গানের রেকর্ড সম্ভবত ১৯৬৮ সালে বাজারে আসে এবং এই এক গানেই বাজারমাত করেন শেফালী। বাংলাদেশে টেলিভিশনে তার প্রথম গান প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে, রেকর্ডের গানটিই (ওরে সাম্পানওয়ালা) গেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে লন্ডনের প্রখ্যাত মিলকা লিমিটেড শেফালীর ১০টি গানের ক্যাসেট ও লংপ্লে বের করে। শেফালীর চিরসবুজ কিছু গান হলো, ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’, ‘সূর্য ওডেরলে ভাই লাল মারি’, ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম’, ‘সোনা বন্ধু’, ‘ও শ্যাম রেঙ্গুন ন যাইওরে’, ‘নাতিন বরই খা’, ‘কি জ্বালা দি গেলা মোরে’, আঁধার ঘরত রাইত হাড়াইয়ুম কারে লই’, ‘চোডকাইল্যা পিরিত আঁর’, ‘ন মাতাই ন বুলাই গেলারে বন্ধুয়া’, ‘ঢোল বাজের আর মাইক বাজের’, ইত্যাদি। তিনি বসুন্ধরা, মাটির মানুষ, বর্গী এলো দেশেসহ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও গান করেছেন। চলচ্চিত্রে গাওয়া তার দারুণ জনপ্রিয় গান হলো ‘তুমি যে আমার জীবনের উপহার’, ‘মানুরে সুন্দর মানু, কি ছবি বানাইবা তুঁই’, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুলরে…।’
১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম বেতারের সম্প্রচার কেন্দ্র কালুরঘাট থেকে আগ্রাবাদে স্থানান্তর হয়। তখন চট্টগ্রাম বেতারের আরডি আশরাফুজ্জামান ছিলেন জহুরি। ওই সময় মলয় ঘোষ দস্তিদারের লেখা ‘নাইয়র গেলে বাপর বাড়ি আইস্য তরাতরি’ গানিট শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দও বৈষ্ণবকে দিয়ে রেকর্ড করে প্রচার করেন আশরাফুজ্জামান। ওই গান গেয়ে শ্যাম-শেফালী জুটি দর্শকের ব্যাপক সাড়া পায়। কাছাকছি সময়ে আশরাফুজ্জমানেরই চেষ্টায় শ্যাম-শেফালী জুটির আরেকটি দ্বৈতকণ্ঠের আঞ্চলিক গান বেতারে প্রচার হয়। সে গানটি ছিল আবদুল গফুর হালীর ‘ন যাইও না যাইও আঁরে ফেলাই বাপর বাড়িত ন যাইও।’ মলয় ঘোষের গানটি শ্যাম-শেফালী জুটিকে প্রতিষ্ঠিত করলে গফুর হালীর গানটি এই জুটিকে দর্শকদের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে যায়। শেফালী ঘোষ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ঝরা বকুল, তাকে নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষ গানের মালা গাঁথবে, গণমানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন গানের ফুল শেফালী।

লেখক : লোকসংগীত গবেষক ও সাংবাদিক