শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন-ইতিহাসের নূতন অধ্যায়

আবদুল মান্নান »

বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি করলো। বাংলাদেশের বিগত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস যদি দেখি তা হলে তাকে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাড়ে তিন বছর যা ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পুনর্গঠনকাল । কেমন ছিল সেই সাড়ে তিন বছর তা আজকের প্রজন্মকে বুঝানো মুস্কিল। শুধু একটা উদাহরণ দিলে হয়তো কিছুটা আঁচ করা যাবে । বিদেশ হতে খয়রাতির (রিলিফ) চাল বা গম না আসলে অনেক বাড়িতে চুলা জ্বলতো না। সেই এক যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু যখন ধ্বংসস্তূপ হতে টেনে তুললেন ঠিক তখনই এক দল ঘাতক ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে সপরিবারে ধানমন্ডির নিজস্ব বাসভবনে তাঁকে হত্যা করে। ঘটনা চক্রে বেঁচে যান বিদেশে অবস্থানরত তাঁর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। ঘাতকের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা, বঙ্গবন্ধুর একান্ত আস্থাভাজন খন্দকার মোশতাকের হাত ঘুরে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয় জেনারেল জিয়ার হাতে। এর পর শুরু হলো আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দুঃসময়ের কাল। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করে আওয়ামী লীগকে ও বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিলে নির্ঘাত জেল। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন ছুটি কাটাতে শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া সহ গিয়েছিলেন বেলজিয়ামে। ড. ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল ছিল জার্মানিতে। উঠেছিলেন বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার সংবাদটি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও ড. ওয়াজেদ মিয়া রাষ্ট্রদূতের বাসায়ই পান। এটি তাঁদের কাছে শুধু চরম একটি বিয়োগান্তক ঘটনাই ছিল না, অবিশ্বাস্যও ছিল।
বেলজিয়ামে অবস্থান কালে সবচেয়ে অমানবিক আচরণটি করেছিলেন রাষ্ট্রদূত সানাউল হক । তিনি জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীকে ফোনে বলেন তিনি যেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের তার বাড়ি হতে সত্বর নিয়ে যেতে ব্যবস্থা করেন। বেলজিয়াম দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারকে বেলজিয়াম সীমান্তে পৌঁছে দিতে রাজি হন। জার্মানিতে অবস্থান কালে হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী জার্মানিতে দায়িত্বরত ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়ইকে পুরির সহায়তায় ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ করে শেখ হাসিনাকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অনুরোধ করলে ইন্দিরা গান্ধী তাৎক্ষণিক রাজি হয়ে যান। আগস্টের ২১ তারিখ শেখ হাসিনা দিল্লীর উদ্দেশ্যে জার্মানি ত্যাগ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁদেরকে মাতৃস্নেহে গ্রহণ করেন। ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে ড. ওয়াজেদ মিয়ার জন্য একটি গবেষকের চাকুরিরও ব্যবস্থা করে দেন। শেখ হসিনা প্রথমবারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর কাছেই ঢাকার পুরো ঘটনার বর্ণনা শুনতে পান।
শেখ হাসিনা যখন দিল্লিতে তখন জেনারেল জিয়া বাংলাদেশকে মোটামুটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করে ফেলেছেন। শাহ আজিজের মতো চিহ্নিত রাজাকারকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। ঘাতক আবদুল আলিমকে বানিয়েছেন মন্ত্রী । জামায়াতের প্রধান গোলাম আযমকে বাংলাদেশে আসতে দিয়েছেন। বাহাত্তরের সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবেনা বলে একটি ধারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে উচ্চপদে পদায়ন করেছেন । পাকিস্তানি আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শ্লোগান চালু করেছেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এগারো হাজার পাকিস্তানি দালাল রাজাকার আলবদর বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে ছিল। জিয়া তাদের সকলকে মুক্ত করে দেন। পুরোপুরি যেই দেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মত্যাগকে জিয়া পদদলিত করেছেন । জিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করেই আওয়ামী লীগের সকল শীর্ষস্থানীয় নেতা কর্মীকে জেলে পুরেছেন। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অনেকটা ছত্রভঙ্গ । এই সময় দলের হাল ধরেছিলেন শহীদ তাজউদ্দিনের স্ত্রী বেগম জোহরা তাজউদ্দিন । সাথে ছিলেন দলের কিছু তরুণ নেতা । কিন্তু সকলে জানতেন দলকে আবার জীবন দেয়ার জন্য প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর একজন উত্তরাধিকার। ১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ড. কামাল হোসেন দলের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করলে তা সর্বসম্মতক্রমে গৃহিত হয় । দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতা দিল্লি গিয়ে শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরিয়ে আনেন ।
জিয়ার বাংলাদেশে শেখ হাসিনার থাকার জায়গাও নেই। উঠলেন এক ফুফুর বাড়িতে । স্বজনদের জন্য দোয়া করতে যেতে চাইলেন ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে নিজ বাড়িতে। অনুমতি মিললো না। সামনের রাস্তায় বসে দলের কয়েকজন নেতা কর্মীকে নিয়ে দোয়া পড়লেন। কাকতালীয়ভাবে জিয়া এক সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে ৩১ মে ১৯৮১ সালে নিহত হন। তারপর জিয়ার উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের হাত ঘুরে ক্ষমতা দখল করলো আরেক জেনারেল এরশাদ। যা জিয়া তা এরশাদ। দুজনের মধ্যে চরিত্রগতভাবে কোন তফাৎ নেই। এরশাদও তার পূর্বসূরির রেখে যাওয়ার বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করার কাজে মনোনিবেশ করার দিকে নজর দিলেন। এরশাদ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যোগ করে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেন। দ্রুত এরশাদ হয়ে উঠলেন একজন স্বৈরশাসক । আশির দশকের মাঝামাঝি দেশের ছাত্র সমাজ প্রথমে শুরু করলো এরশাদ বিরোধী আন্দোলন । কিছুদিন পরেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের পরে এই গণআন্দোলন সফল হয় এবং ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদ একটি অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে ভুল নির্বাচনী কৌশল, প্রতিপক্ষকে সঠিক মূল্যায়ন না করা, জামায়াতের সাথে গোপনে নির্বাচনী আঁতাত আর শেখ হসিনার নেতৃত্বের জোট হতে আলাদা হয়ে বাকশালের পৃথক প্রার্থী দেয়ার কারণে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করতে ব্যর্থ হয়। এই পরাজয়ে অনেকের মনোবল ভেঙে গেলেও শেখ হাসিনা তাঁর পূর্বের অভিজ্ঞতা ‘আবার ফিরে আসবো’র মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শক্ত হাতে দলকে পুনরায় পুনরুজ্জীবিত করার দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করেন বেগম জিয়া। এই সরকারের একমাত্র উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিলো দেশের শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি হতে সংসদিয় পদ্ধতিতে ফিরে যেতে সংবিধান সংশোধন করা ।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ একুশ বছর পর পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে । তবে নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়াতে সরকার গঠন করতে তাদের প্রয়োজন হয় জাসদ (রব) আর জাতীয় পার্টির সমর্থন । সরকারের নাম হয় মহাজোট সরকার। দেশ শাসনে প্রতি পদে পদে বাধা । শেখ হাসিনার এই মেয়াদে তিনি সংবিধানে জিয়া বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচার না করার জন্য যে ইনডেমনিটি আইন সংবিধানে সংযোজন করেছিল তা সংসদে বাতিল করে পঁচাত্তরের খুনিদের বিচার শুরু করতে পেরেছিলেন যা ২০০১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দিয়েছিলেন ।
২০০৯ সালে অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে শেখ হাসিনা এইবার নিয়ে পর পর তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। যে শেখ হসিনা ১৬ মে ১৯৮১ সালে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ ছয় বছর পর দেশে ফিরেছিলেন, প্রাথমিক শক সামলে উঠে যে শেখ হাসিনা বাবার গড়ে তোলা দলটিকে নিজের মেধা, মনন আর একাধিকবার জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ হতে ফিরে এসেছেন সেই শেখ হাসিনা এখন শুধু বাংলা নামের দেশটির একজন প্রধানমন্ত্রীই নন তিনি বিশ্বনন্দিত একজন রাষ্ট্রনায়কও বটে । তাঁর পর পর তিন দফার মেয়াদকালে সফলতার সাথে তিনি সামলেছেন একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিডিআর বিদ্রোহ, আর বেগম জিয়া পরিচালিত ২০১৩-১৪ সালের পেট্রোল বোমার সন্ত্রাস। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই বাংলাদেশে বর্তমান মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২০৮৬ ডলার আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে। কৃষিতে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ । বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে লিপ্ত তখন এই শেখ হাসিনাই সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থেই হবে । কর্ণফুলি নদীর নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ । মানুষের কল্পনারও বাইরে । তা এখন প্রায় ৬৫ শতাংশ সমাপ্ত । সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু। সেই বাংলাদেশ এখন ২১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম । রূপপুরে নির্মিত হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র । রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বাংলাদেশের উপগ্রহ মহাকাশে ঘুরছে । জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের সিঁড়ি অতিক্রম করছে। গত বারো বছরে বদলে গেছে বাংলাদেশ।
এক জীবনে একজন মানুষের পক্ষে যা করা সম্ভব তা শেখ হাসিনা করে ফেলেছেন । তাঁর সামনে এই মুহূর্তে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে । প্রথম চ্যালেঞ্জ দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা । এই ভয়াবহ রোগটি দেশের প্রশাসন যন্ত্রকে খেয়ে ফেলেছে । এটি করতে হলে যথাযথ মানুষকে যথাযথ জায়গায় নিয়োগ দিতে হবে। দেশটিকে অর্ধশিক্ষিত কাঠমোল্লারা যারা আবার নিজেরাই নিজেদের ‘শাইখ’, ‘আল্লামার’ মতো উপাধিতে ভূষিত করে গিলে ফেলার উপক্রম করেছেন তাদের কাছ হতে উদ্ধার করতে হবে । তার জন্য চাই ধর্মীয় শিক্ষা সহ সকল শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করা। মনে রাখতে হবে জোব্বা আর মাথায় পাগড়ি বাঁধলে আর দাঁড়িতে মেহেদি লাগালে ইসলামী চিন্তাবিদ হওয়া যায় না । তার জন্য লেখাপড়া প্রয়োজন । সব শেষে এটি বলতেই হয় শেখ হাসিনা যিনি এই দেশকে বিশ্ব দরবারে একটি পরিচিতি দিয়েছেন, যিনি বাংলাদেশের ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর তিনি যাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন তারা সকলে তাঁর প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বস্ত নন । এদের চিহ্নিত করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।
শেখ হাসিনা আরো দীর্ঘায়ু হন এই প্রার্থনা করি। দেশকে দিয়েছেন তিনি অনেক কিছু দেওয়ার আছে আরো বেশ কিছু । ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনাতো নয়, দেশে ফিরেছিল বাংলাদেশ । ৭ই মে ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকারের বাধা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা যখন বিদেশ হতে দেশে ফিরেছিলেন সেদিন গণতন্ত্র দেশে ফিরেছিল। তাঁর শাসনামলের সকল অর্জন ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন যোগ্য মানুষের যথার্থ মূল্যায়ন। জয়তু শেখ হাসিনা। জয়তু বাংলাদেশ ।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক