শব্দ

জোবায়ের মিলন :

 

 

ক্যাচক্যাচ একটা শব্দে ঘুম ভাঙলো নিলিমা বেগমের। ঘরে চোর ঢুকলো না স্বপ্ন- ভেবে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো সে। না; শব্দটা হচ্ছে। বালিশের নিচ থেকে দ্রুত মোবাইলটা বের করে বাটন টিপে আলো জ্বালিয়ে দেখলো- রাত তিনটা। পাশের রুম থেকে শব্দটা আসছেই। একটা ছন্দে, এক নাগাড়ে। নিলিমার স্মরণ হলো সেই রাতের কথা, যে রাতে তার ফুলশয্যা ছিল। তার নতুন স্বামী তাকে জড়িয়ে ধরে যখন ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছিল তখন পুরনো খাটের এমন চিকন শব্দটা তাকে বেশ লজ্জায় ফেলেছিল। যা নিয়ে পরের সকালে তার এক নানির মশকরার অন্ত ছিল না।

নিলিমা বেগম ভালো করে কানটা খাড়া করে। শব্দটার সাথে সেই রাতের শব্দটার কোন পার্থক্য নেই! নিলিমা আশ্চর্য হয়। পাশের রুমে থাকে খাদিজা। ও-রুম থেকে এমন শব্দ তো আসার কথা না! ওই রুমে দুইটা আমকাঠের সিঙ্গেল খাটে একটাতে থাকে লতিফা আরেকটাতে খাদিজা। লতিফা গতকাল অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামে গেছে তিনদিনের জন্য। রাত দশটা পর্যন্ত খাদিজা আর নিমিলা এক সাথেই টিভি দেখলো। গল্প করলো। খাওয়া-দাওয়া করলো। নিলিমার কানে শব্দটা এক তালে বেজেই যাচ্ছে। দু’হাতে চোখ কচলিয়ে নিলিমা ধীরে ধীরে খাট থেকে নামে, পা টিপে টিপে টিনে পেরেকের ছোট্ট ফুটো দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করে। কিছু দেখা যায় না। ভর অমাবস্যার রাতের মতো রুমটা অন্ধকারে ঠাসা।

টিনের সাথে কানটা চেপে ধরে নিলিমা। খচ্ করে ওঠে বুকটা। কি যেন, কে যেন তার বুকের বাম পাশটায় একটা ধাক্কা লাগে। কাঁচা পেঁপের টুকরো চিবালে যেরকম কচকচ শব্দ সেরকম চাপাস্বরের শব্দ ওঠে নেমে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। নিলিমা চলে যায় তার দ্বিতীয়, তৃতীয় রাতের কথায়। তার নতুন স্বামী যখন পাগলা ঘোড়ার মতো দৌড়াতো তার জমিনটার ওপর; তখন না কান্না, না হাসি, না ব্যথায় একহাতে মানুষটার পিঠ খামচে ধরে আরেক হাতে নিজেই নিজের মুখটা চেপে রাখার পর যে শব্দটা আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে ওঠে নেমে যেত সে শব্দটার কথা। নিলিমা অল্পশিক্ষিত গ্রাম্য মেয়ে। হিসাবটা তার মিলে না।

খাদিজা সন্ধ্যারাত থেকে সালোয়ার-কামিজের পরিবর্তে শাড়িতে সজ্জিত। অন্যরাতের চেয়ে আলাদা। স্নো-পাউডারও মেখেছিল। খাদিজাকে কেমন যেন উড়ু-উড়– লাগছিল। কম বয়স, মনের রঙ … ইত্যাদি ভেবে নিলিমা কিছু জিজ্ঞেস না করে এড়িয়ে গিয়েছিল। খাদিজা একবার বলেও ছিল- ‘বুবু ঘুমাইবা না? ভোরে উঠন লাগবো তোমার। মনে আছে?’ তার মানে কি এই? নিলিমা তার কানটা টিন থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে আনে। নিলিমা ঘামতে থাকে। মাথাটা ঘুরতে থাকে।

সামনের ইশার সুলতান মিয়ার লগে খাদিজারে কোনো কোনো ছুটির দিনে মার্কেটে ঘুরতে দেখা যায়, এদিক-ওদিক বসতে দেখা যায়। দেখা যাইতেই পারে! লতিফা একদিন ইঙ্গিত দিয়েছিল- ‘বুবু, খাদিজার কাছে সুলতান মিয়া কী কারণে যেন ঘন-ঘন আসে। হাইস্যা-হাইস্যা কথা কয়। কী যেন দেয়ও। খাদিজাও হাইস্যা হাইস্যা কথা লয়।’ চট করে কথাগুলো নিলিমার খেয়ালে আসে। যদিও কথাগুলো নিলিমা অমনভাবে নেয়নি কখনো। ‘কোনো মানুষের কাউরে না কাউরে ভালোলাগতে পারে। ভালোলাাগলে দোষের না। প্রেম-পিরিতি জগতের রীতি।’ নিলিমার মনের কথা। নিলিমা অশিক্ষিত হলেও এটা বুঝে।

তার কাছে সব ওলটপালট লাগে। ভালোবাসা মানে মধ্যরাত! ভালোলাগা মানে শরীর! তবে রইলটা কী!  সে বিড় বিড় করে। নিলিমা সুলতান মিয়াকে আগে থেকেই পছন্দ করে না। আগের অফিসে থাকতে অনেক মেয়ের সাথেই তার সম্পর্ক ছিল। কারো সাথে কথা রাখে না। কয়েকদিন ঘুরে-ফিরে সম্পর্ক পাল্টায়। একবার পাশের গলির এক মেয়ের পেট হওয়ার পর সে অস্বীকার করলে লোকজন ধরে আটকে রেখেছিল। কিন্তু পাড়ার মাস্তানদের টাকা-পয়সা দিয়ে বেঁচে গেছে। মেয়েটা নিরুপায়। নিলিমা আর ভাবতে পারে না। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। নবীনপুর থেকে খাদিজা যখন নিলিমা বেগমের সাথে শহরে আসে কাজের জন্য তখন নিলিমা বেগম খাদিজার মাকে কথা দিয়েছিল, খাদিজাকে সে দেখে রাখবে। শহরের আজব ধাঁধা থেকে আগলে রাখবে ছোটবোনের মতো। তবে কি সুলতান মিয়াই খাদিজার ঘরে! সে কি ঘরের লাইট জ্বালবে, নাকি দরজা খুলে খাদিজার দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকবে, ‘এই খাদিজা দরজা খোল। তোর ঘরে কে?’ নাকি ভাড়া বাড়িটার সবাইকে জাগাবে! ভেবে পায় না নিলিমা বেগম।

নিঝুম রাতে শব্দটা আরও তীব্রভাবে নিলিমার কানে লাগে- ক্যাচক্যাচ … ক্যাচক্যাচ … যেন পুরান খাটের পায়াগুলো ভেঙে পড়ছে একটা একটা করে। যেন বৈশাখ মাসের ঝড়ের এক-একটা ছোবল এসে আছড়ে পড়ছে নিলিমার কানে। নিলিমার বুকে ধক্ধক্ ধক্ধক্ শব্দ হচ্ছে। নিলিমার চোখে ভাসছে খাদিজার মায়ের সেই কথাগুলো, ‘মা, মেয়েটারে দেইখা রাখিস। উঠতি শরীর; সাপ-বিছার আছর লাগতে পারে। পুরুষ বড় মায়া, মায়া শব্দ নারীর কাল, না বুঝলে বিনাশ।’ শেষতক কি খাদিজা বিনাশের কিনারে এসে দাঁড়ালো? নাকি আদিম সত্যের কাছে সমর্পিত হলো আপনসুখের উচ্ছ্বাসে? নিলিমা বেগম এর কোনো উত্তর দিতে পারে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকার, চুপচাপ, শূন্যের মতো নীরব রুমটায়।

আর ওদিকে শব্দটা হতেই থাকে ক্যাচক্যাচ. . .ক্যাচক্যাচ …।