লাফুদের কান্না

মুহাম্মাদ সোহাগ :

বিশাল বড় একটা পুকুর। তার পাড়গুলোও খুব উঁচু উঁচু। পশ্চিম পাশে আছে কয়েকটা নারিকেল গাছ আর উত্তর পাশে কয়েকটা তাল গাছ। এছাড়া পুকুরের সারা পাড়জুড়ে সারাবছরই আবাদ হয় বিভিন্ন শাক আর সবজির। হাওর অঞ্চলের এক গ্রামের এমনই এক পুকুরে এক সাথে বসবাস করছে হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ কাতলা মাছ।

সেই অগণিত কাতলামাছের মধ্যে একটা কাতলা ছিল অনেক মিশুক এবং খুবই ভালো। সে সবার সাথে মিশতো, সবাইকে ভালোবাসতো। তাই অন্যসব মাছেরাও তাকে খুব ভালোবাসতো। এই কাতলাটার একটা শখ এবং অভ্যাস হচ্ছে সে সব সময় কোনো কারণ ছাড়াই মজা করার জন্য শুধু লাফালাফি করতো। তাই অন্য সব কাতলারা তাকে ‘লাফু’বলে ডাকতো।

লাফু আর তার আজস্র প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কয়েকটা মজার বিষয় হলো, তাদের সবার বয়স এবং শরীর একই সমান। তারা একই দিন থেকে এই পুকুরে বসবাস করছে।

লাফুরা সবাই যখন একদম ছোট্টপোনা তখন থেকেই তারা সবাই এক সাথে এই পুকুরে আছে। এখানে তাদেরকে অনেক আদর-যতœ করা হয়। নিয়ম করে প্রতিদিন কয়েকবার সঠিক সময়ে কয়েকজন মানুষ এসে মজাদার খাবার ছিটিয়ে দিয়ে যায়। এগুলো লাফুরা খুব মজা করে খায়। যারা খাবার  দেয় তাদের প্রত্যেকটা মানুষের চেহারা লাফুরা চেনে। ওই মানুষগুলো মাঝে মাঝে জাল টেনে অনেক মাছকে একত্র করে এক এক করে দেখে কারো কোনো  অসুখ-বিসুখ হলো কিনা। হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে একদমই দেরি করে না। ডাঙায় থাকা সেই মানুষেগুলো লাফুদের এত আন্তরিকতার সাথে লালন-পালন করে বলে লাফু আর তার সকল সাথি তাদের অত্যন্ত ভালোবাসে। তাদের দেখলেই লাফুরা আনন্দে লাফালাফি আর নাচানাচি আরম্ভ করে।

এ রকম ভাবেই চলছিল লাফুদের জীবন। হঠাৎ একদিন খুব বৃষ্টি শুরু হলো। যদিও আগেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হতো। কিন্তু  তা আবার থেমেও যেতো। কিন্তু এবার প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে  গেলো বৃষ্টি তো একটু সময়ের জন্যও থামছে না। এ কারণে পুকুরের পানিও আগের থেকে প্রায় তিনগুণ বেড়ে উঁচু পাড়গুলোর সমান হয়ে গেছে। লাফু এখন একটু লাফ দিলেই পুকুর পাড়ের নীলজালের বেড়ার ভেতর দিয়ে অসীম জলের সীমাহীন হাওরটাকে সহজেই দেখতে পায়। এতো বড় জলাশয় বা হাওর লাফু ও লাফুর বন্ধুরা আগে কখনো  দেখেনি। সবাই সেই হাওরটাকে দেখে খুব মজা পেলো। পানি বেশি হওয়ায় নানান কারণে লাফু আর তার বন্ধুরা এক অন্যরকম আনন্দ উপভোগ করছিল।

হঠাৎ একরাতে শুরু হলো অনবরত তুমুল ঝড়বৃষ্টি আর উজান থেকে বয়ে আসতে লাগলো প্রচুর পরিমাণে পানি। ফলে লাফুদের প্রিয় বাসস্থান সেই পুকুরটিতে পানি অতিমাত্রায় বেড়ে পুকুরটি ডুবে হাওরের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেলো। তখন প্রবল বাতাস আর পানির তীব্র  স্রোতের ফলে জন্ম থেকে এক সাথে থাকা লাফুর সব বন্ধু আর পরিচিত মাছেরা চিরতরে হারিয়ে গেলো একজন আরেকজনের থেকে। লাফু ও তার বন্ধুদের কেউ কেউ আবার পুকুরপাড়ের গাছের শিকড়-বাকড় বা লতাপাতাকে আশ্রয় করে বহু কষ্টে সেই পুকুরে থাকতে সমর্থ হলো।

ঝড়বৃষ্টি থামার পর ভোরবেলা দেখা গেলো থেকে যাওয়া মাছেদের সংখ্যা খুবই কম। তাদের সাথে যুক্ত হলো পুকুরের বাইরের নদী-হাওর ও অন্য জলাশয় থেকে জলের স্রোতে  ভেসে আসা নানান প্রজাতির হরেকরঙয়ের বেশ কিছু মাছ। যাদেরকে এই পুকুরের কাতলারা আগে কেউ কখনো দেখেনি, তাদের কথাও শুনেনি। সবাইকে হারিয়ে ভীষণ দুঃখে থাকা লাফুরা বিচিত্র আকার ও ভিন্ন ভিন্ন রঙয়ের নতুন মাছদের দেখে তাদের সাথে আলাপ-পরিচয় করে খানিকটা আনন্দিতই হলো।

প্রায় সবাইকে হারিয়ে লাফু আর তার থেকে যাওয়া কয়েকজন বন্ধু খুব কষ্ট পেয়ে কান্না করতে লাগলো। এমন সময় একটা নৌকা করে পুকুরে ছুটে আসলো লাফুদের যারা খাবার দিতো সেই মানুষগুলো। পরিস্থিতি দেখে নিজেদের সম্পদ হারানোর বেদনায় তারাও কান্নায় ভেঙে পড়লো।