রমজান আলী মামুন ও কিছু স্মৃতি

এমরান চৌধুরী »

বাংলাদেশের অন্যতম প্রিয় শিশুসাহিত্যিক, কবি ও কথাশিল্পী রমজান আলী মামুনের অসময়ে প্রস্থান আমাদের কাছে বড়ো বেদনার। মাত্র একান্নটি (জন্ম: ৩ আগস্ট ১৯৬৮, মৃত্যু ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯) বসন্ত পেরোনো এই চিরসবুজ কবি নিজে কাঁদলেন না। অন্যকে কাঁদালেন অঝোরে-বুক চাপড়ে। কাঁদালেন চট্টগ্রামের সকল শিশুসাহিত্যিককে, কাঁদালেন বদরপাতির সকল মানুষকে।
রমজান আলী মামুনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই শহরেই, বদর পুকুর উত্তর পাড়ে। তাঁর পিতার নাম: মরহুম গজনফর আলী, মাতার নাম : মরহুমা হাজী গোলশান নাহার বেগম। রমজান আলী মামুন মৃত্যুকালে স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম রেখা বেগম। দুই পুত্রের নাম বাপ্পারাজ ও আলী রাজ। আর একমাত্র মেয়ের নাম নুসরাত জাহান পাপিয়া।
তাঁর প্রকাশিত একটি কাব্যগ্রন্থের নাম— আমার অনেক কষ্ট আছে। এটি প্রকাশিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭। বইটার বেশ কাটতি হয়েছিল। টগবগে এক তরুণ, তার ওপর রাজপুত্রের মতো চেহারার মানুষটার ভেতরে কোনো কষ্ট থাকতে পারে কখনো সিরিয়াসলি ভাবিনি। তাঁর সেই কষ্ট কার জন্য তার জবাব এসেছিল একুশ বছর পর তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে ‘তোর জন্য কষ্ট আমার’।
রমজান আলী মামুনের শিশুদের জন্য লেখা গ্রন্থের সংখ্যা বারোটি। দুটি কাব্যগ্রন্থসহ মোট প্রকাশিত গ্রন্থ চৌদ্দ। তাঁর প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থের নাম হারিয়ে যাওয়া দুপুরে। তাঁর অন্য ৫টি কিশোর গল্পগ্রন্থের নাম হলো: আকাশপরী ও পাপিয়া, এক যে ছিল রাজকন্যা, দিবা ও রহস্যময় বুড়ো, কিশোর নেমেছে যুদ্ধে, খুকি ও রবীন্দ্রনাথ, ২টি কিশোর উপন্যাস হলো : রেল ছোটে মন ছোটে, মিঠু তুমি স্বাধীনতা। ৩টি কিশোর কবিতাগ্রন্থ: নীল ডানা এক পাখি, সবুজাভ কোন গ্রামে, আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ, একমাত্র ছড়াগ্রন্থ: ছড়ার গাড়ি থামবে বাড়ি এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর মননশীল প্রবন্ধগ্রন্থ ‘নবিকাহিনী’।
সাড়ে তিন দশক ধরে লেখালেখিতে সম্পৃক্ত থেকে তিনি পেয়েছেন মনন সাহিত্য সম্মাননা, বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি কিশোর কবিতা সম্মাননা,বঙ্গবন্ধু একাডেমি কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সম্মাননা, অক্ষরবৃত্ত শিশুসাহিত্য পা-ুলিপি পুরস্কার, সবশেষে মৃত্যুর ৪৮ ঘণ্টা আগে গ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি পদক। রমজান আলী মামুন শুধু একজন সুলেখকই নন, ছিলেন একজন তুখোড় সংগঠক। তাঁর লেখালেখির শুরুর দিকে তিনি ‘কিশোর সমাবেশ’ নামে একটি ট্যাবলয়েড সম্পাদনা করতেন। তিনি মাসিক শিশু সাহিত্য পত্রিকা ‘কথন’ এর নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক আন্দরকিল্লার ছোটদের পাতার বিভাগীয় সম্পাদক, সাহিত্য সংগঠন ‘স্বকাল’ এর অন্যতম পরিচালক, শিশু কিশোর সাময়িকী ‘আলোর পাতার’ সম্পাদনা পর্ষদ সদস্য, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঐতিহ্য সাংস্কৃতিক ফোরাম’ এর সিনিয়র সহ সভাপতি।চট্টগ্রাম একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু সাহিত্য একাডেমির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। প্রথম জাতীয় ছড়া উৎসবে তিনি রাখেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। রমজান আলী মামুন বড় অভিমানী ছিলেন। তবে সেই অভিমান কখনো প্রকাশ করতেন না। তাঁর পরম ধৈর্য শক্তি ছিল। যে শক্তির বলে শত টানাপোড়নের মধ্যেও চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন সুকুমার শিল্পের চর্চা। তিনি গৃহী হয়েও সন্ন্যাসীর মতো জীবন যাপন করে গেছেন। তাঁর জীবনটা এত সাধারণ ছিল যে খুব অল্পে তিনি তুষ্ট থাকতেন।
কবি রমজান আলী মামুন জ্ঞাতসারে হোক অজ্ঞাতসারে হোক জীবনের নিরেট বাস্তবতার কথাটি বলে গেছেন তাঁর কবিতায় অত্যন্ত সাবলীলভাবে। সত্যিই তো একজন মানুষের বিদায়ে সবার ক্ষতি হয় না। হয় কারো না কারো। সে ক্ষতি কখনো পূরণ হবার নয়- হয় না।
এই যেমন ক্ষতি হলো আমাদের, শিল্প ও সুন্দরের।

লেখক : ছড়াকার, প্রাবন্ধিক