মৃত্যুপুরী

চৌধুরী শাহজাহান :

শেলি খুব দুশ্চিক্তায় আছে কয়েকদিন ধরে। রাতে ঘুম হয় না তার।  টেনশন আর  টেনশন। ভাবখানা এমন যেন কোনো আপনজন পৃথিবী  থেকে বিদায় নিয়েছে চিরতরে। চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলছে প্রতিরাতে। এ রকম অবস্থায় তাকে কখনো দেখা যায়নি। স্বামী-সন্তাননিয়ে সে  তো সুখেই দিনযাপন করছে চট্টগ্রাম শহরে। কোনো বাড়তি ঝামেলাও নেই। শ্বশুর-শাশুড়ি থাকে গ্রামের বাড়ি দেবর মোস্তফার পরিবারের সাথে। বছরে দু-একবার পরিবারের সবাইকে নিয়ে চৌদ্দগ্রাম যায় শ্বশুরালয়ে বেড়াতে। নির্ঝঞ্ঝাট পাঁচ সদস্যের সাংসারিক জীবন। স্বামী তাকে প্রচ- ভালোবাসে তাকে। এরপরও তার মনখারাপের রহস্য কী? নাকি চলমান বিশ্বকরোনা পরিস্থিতি? মৃত্যুর মিছিল?  টেলিভিশন, ফেসবুক, মেসেনজার ইত্যাদির নিউজ আপডেট দেখে-দেখে সে কি আতঙ্কিত? মানবজীবন হাজারো রহস্যে ঘেরা। মানুষের মনের গহীনে কি বেদনা লুকিয়ে থাকে বোঝা ভার।

শেলির মেজোভাই জিয়া ও ছোটবোন এলিনা উভয়ই  কানাডা থাকে প্রায় একযুগ ধরে। তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। এখন স্কুলে যায়। তাদের নিয়ে কোনো  টেনশন করছে না তো শেলি? করোনা পেন্ডামিকে ভুগছে  গোটা দুনিয়া। টেনশন তো হতেই পারে। টেনশন ছাড়া কি দুনিয়ায় কোনো মানুষ আছে?

ছোটভাইটার কথাও এখনো ভুলতে পারেনি সে। বিয়ের কয়েকদিন পর ভাইটি প্রবাাসে সড়ক দুর্ঘনায় মারা যায়। ভাইটি সিভিল ইন্জিনিয়ার ছিল। দেশে একটি নামজাদা  কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরিও করতো। হঠাৎ তার মাথায় ভূত চাপলো। সে দেশে থাকবে না। ইউরোপ যাবে। শেষে তার প্রবল ইচ্ছার কারণে অনেক চেষ্টা-তদবির করে বিদেশে পাঠানো হলো ওকে। সে খুব উচ্চাকাক্সক্ষী ছিলো। দুর্ভাগ্য তার। মৃত্যুর তিনমাস পর লাশ আসলো দেশে। পুরো সময়টি লতিফা বেগম পুত্রশোকে কেঁদেছে আর আহাজারি করেছে। সেসব কথা মনে পড়লে শেলির বুক ফেটে কান্না আসে। হায়  রে ক্ষণিকের দুনিয়া! কত কিছুই না আমরা পেতে চাই এখানে। ধনদৌলত, সোনাদানা, বাড়ি-গাড়ি, প্রভাব-প্রতিপত্তি। অথচ দম ফুরালে সঙ্গে তো কিছুই যায় না। নির্জন মাটির ঘর হয়ে ওঠে অনন্তকালের ঠিকানা।

দুহাজার বিশ সালের জানুয়ারি মাসের দিকে করোনাভাইরাস মহামারি আকারে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। চীনের উহান আর উবেই শহরে ভাইরাসটি প্রথম মরণছোবল হানে। চীনে চারমাসে প্রায় পাঁচ হাজার  লোক মারা যায়।এই অদৃশ্য অণুজীব একটি ছোঁয়াচে  রোগ। সারাবিশ্ব ভ্রমণের মাধ্যমে কোভিদ ঊনিশ করোনা ভাইরাসটি দ্রুত একদেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচ লক্ষের অধিক মানুষ করোনায় মারা গেল। আরো লাক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়ে  হোমকোয়ারেন্টাইনে আছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব করোনা মোকাবিলায় নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে। মাস্ক হ্যান্ডগ্লাভস ও সেনিটাইজার ব্যবহার করছে সকলে। নিরাপদ দূরত্বে চলাফেরা করছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে। এ যেন এক অচেনা পৃথিবী। অসংখ্য লোক বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। ডাক্তাররাও নিরাপদে নেই। বলা যায় মানুষ এক রকম গৃহবন্দিই। বন্দিজীবন আর ভালো লাগছে না কারো। উপায় কি? আগামীকাল কি হবে  কেউ কিছু বলতেও পারছে ন।

শেলির জেঠা সামসুল হক সাহেবঅনেক বছর হলো সপরিবারে আমেরিকায় থিতু হয়েছেন। ২০০০ সালে তিনি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন থেকে অবসরে গেছেন। চাকরিতে থাকা অবস্থায় সন্তানেরা  একে একে বিদেশ চলে যায়। সবাইকে তিনি কালের উপযোগী করে মানুষ করেছেন। কেউ ডাক্তার, কেউ প্রকৌশলী। দেশে মাঝে-মাঝে বেড়াতে আসেন। নিকট স্বজনদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি চার প্রজন্ম নিয়ে প্রবাসে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে আসছিলেন। সম্প্রতি হক সাহেব করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে সংবাদটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

হক সাহেবের ছাটভাই আমিনুল হক থাকেন বাংলাদেশে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ের পরিবার কানাডা থাকে। বড়ছেলে আর বড় দুই মেয়ের পরিবার-পরিজনও বাংলাদেশে। বুড়াবুড়ি ইতোমধ্যে দুবার হজ করেছেন। কানাডায় বেশ কয়েকবার বেড়িয়ে এসেছেন  ছেলেমেয়ের বাড়িতে। তারা বুড়ো মা-বাবাকে সব সময় খুশি রাখতে চান। আবার কখনো চট্টগ্রামে মেজো  মেয়েকে দেখতে যান। দু’চারদিন বেড়িয়ে আবার ফেনী চলে যান। এভাবে অবসর জীবনের অলস সময়গুলো আনন্দে কাটাচ্ছেন নাতি-নাতনির সান্নিধ্যে।

গতরাত পারভিন আপা ফোনে জানালেন, জেঠা ভালো নেই। তিনি কয়েকদিন ধরে অসুস্থ এবং হসপিটালাইজড। অতিসম্প্রতি টেস্টে করোনা পজিটিভ এসেছে। তারা খুব চিন্তিত। বাঁচবেন কিনা আল্লাহই ভালো জানেন। দশে দোয়া-দরুদ পড়ে তাঁর আশু  রোগমুক্তির জন্য মোনাজাত করা হয়েছে। তিনি  পেট্টোবাংলার জিএম থাকাকালে অনেক বেকার তরুণকে চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র।  জেঠা করোনা আক্রান্ত হওয়ায় শেলির মন খুব খারাপ।  সে কোনোভাবেই দুঃসময়ে জেঠার সেবা করতে পারছে না। পারছে না তার সঙ্গে দেখা করতেও। এ মনোবেদনা  কাউকে বুঝাতেও পারছে না।

ছোটবেলার তিনি শেলিকে খুব আদর করতেন। তার বিয়ের অনুষ্ঠানে জেঠা সপরিবার আশীর্বাদ করতে আসেন। মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেছেন। তার মনখারাপ হয় বিভিন্ন অনিয়ম দেখে।

যেমন, করোনায় মৃতব্যক্তিকে যথাযথ ধর্মীয় আচার-আচরণ ব্যতিরেকে দাফন বা পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই সে মানতে পারছে না। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ, মৃতব্যক্তি যে ধর্মেরই হোন না কেন তাকে সে ধর্মের নিয়মানুযায়ী সৎকার বা সমাহিত করা উচিত। এই ধর্মীয় সম্মানজনক বিদায় একজন মানুষের  অবশ্য  প্রাপ্য।

কিন্তু সংক্রমণের ভয়ে মানুষ আজ পুণ্যের কাজটিও করতে পারছে না। সামাজিক সমাবেশ করা যাচ্ছে না। সারাবিশ্ব আজ নিথর, স্থবির।

যেন এক নির্বাক মৃত্যুপুরীতে অবরুদ্ধ সবাই।

আশরাফুল মাখলুকাত আজ একটি ছোট্ট ভাইরাসের কাছে পরাভূত, অসহায়। অথচ এই ক্ষমতাবান মানুষরা দুদিন আগেও অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে মানুষকে হত্যা করতে কুন্ঠিত ছিল না। প্রকৃতি কখনো কখনো অ্যনাকোন্ডা সাপের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে ছোবল মারে। যা মানুষ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না।