‘মুজিব’ একটি জাতির রূপকার-এর গল্প

হুমাইরা তাজরিন »

‘চলচ্চিত্রটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদী হতে শেখায়। বাঙালি জাতির জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে অতুলনীয় ত্যাগ তা আরও ভালোভাবে অনুধাবনের সুযোগ পেয়েছি। সামগ্রিকভাবে চলচ্চিত্রটির নির্মাণ অনবদ্য। আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই কারণ সকলেই ভালো অভিনয় করেছেন। গল্পটি আরোপিত মনে হয়নি। ইতিহাসকেও কোনোরূপ বিকৃত বা পরিমার্জন করা হয়েছে বলে মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে, আমরা ইতিহাসের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি।’

‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ ছবিটি দেখে এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম রাকিব।

চট্টগ্রাম নগরীর সিলভার স্ক্রিনে গতকাল ১৩ অক্টোবর মুক্তি পাওয়া ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ ছবির প্রথম দিনের প্রথম শোতে গিয়ে দেখা যায়, সকল বয়সের দর্শক ছবিটি দেখতে এসেছেন। ইতিহাসনির্ভর এই ছবি দেখার প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে দর্শকদের মধ্যে।

যথারীতি জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে ছবিটি শুরু হয়। প্রথম দৃশ্যে জাতির পিতার চরিত্রটির কণ্ঠে (অভিনেতা আরিফিন শুভ) গানটি গুনগুন করে উঠলে হল জুড়ে দর্শকেদের দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে ঘটনা এগুতে থাকে।

দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শৈশবের সাথী রেনুর (বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা) সঙ্গে দুরন্ত খোকার (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) বন্ধুত্বে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শক। পরিবারে বাবার সঙ্গে ছেলের গঠনমূলক রাজনৈতিক বিতর্কে দর্শকরা তাঁর পারিবারিক সংস্কৃতির পরিচয় পায়।
সেই সঙ্গে ছাত্র বয়স থেকেই তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকা , নেতৃত্বের গুণাবলি প্রত্যক্ষ করে। কীভাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচয় হয়, সে পরিচয়ের সূত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সোহরাওয়ার্দীর মুগ্ধতা এবং পরবর্তীতে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের অনবদ্য পরিণতি ফুটে ওঠে পর্দায়।

উদীয়মান নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর গণমানুষের সঙ্গে আন্তরিক সম্পৃক্ততা আবেগাপ্লুত করে তোলে দর্শকদের। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও তাঁর সাদাসিধে সহজ-সরল জীবনযাপন মুগ্ধ করে দর্শকদের।

ক্ষমতা গ্রহণের পর অগ্রজদের দিক-নির্দেশনা গ্রহণ এবং সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পান দর্শক। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা, বির্তক, দাবি আদায়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবিচল ভূমিকায় দর্শকেরা এক অপ্রতিরোধ্য মুজিবের পরিচয় পায়।
কেবল নেতা হিসেবে নন, পারিবারিকভাবেও মুজিবকে একজন অমায়িক পিতা, প্রেমময় স্বামী, শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের ভূমিকায় আবিষ্কার করে দর্শক। বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শনের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মুগ্ধতা,পত্র-পত্রিকার স্বাধীনতার জন্য তাঁর দৃঢ় কণ্ঠস্বর, সহধর্মিনীকে যথাযথ মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত করা, সোহরাওয়ার্দীর প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য, দেশের মানুষের জন্য জীবনের সকল ভোগ বিলাসিতাকে বর্জন করে অনিশ্চিত কারাভোগের কন্টকময় জীবন বেছে নেওয়া সবই উঠে এসেছে চলচ্চিত্রটিতে।

বাংলাদেশের জন্মের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো যেমন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬দফা , ১৯৬৯- এর গণঅভ্যুত্থান, ৭ মার্চের ভাষণ, এবং মুক্তিযুদ্ধ ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাজউদ্দিন আহমেদ, মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মানিক মিয়া, তোফায়েল আহমেদের মতো সহায়ক চরিত্রগুলোর সঙ্গে খন্দকার মোস্তাক, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মতো নেতিবাচক চরিত্রেরও দেখা মেলে চলচ্চিত্রটিতে। এতো গুরুগম্ভীর বিষয়াবলি থাকলেও শামসুল হক চরিত্রে সিয়াম আহমেদের হাস্যরসাত্মক অভিনয়ে হো হো করে হেসে ওঠেন দর্শক।

চলচ্চিত্রটিতে নারী চরিত্রে ইন্দিরা গান্ধী এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসার ভূমিকায় ফুটে ওঠে রাজনীতির ভেতরে এবং বাইরে থাকা তৎকালীন নারীদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। খন্দকার মোস্তাকের চরিত্রে বিশ্বাসঘাতকতার মূলে ব্যক্তিগত অসন্তোষও প্রকাশ পায় এখানে। মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে ভারতের নিরবিচ্ছিন্ন সহায়তার চিত্রও এখানে রয়েছে। সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রটির চরিত্রায়ণ, মেক-আপ, সংলাপ , পোশাক , দৃশ্যায়ন, চিত্রনাট্য ,আলোকায়ন , শব্দায়ন, চরিত্রগুলোর ভাষাগত দক্ষতা সবকিছু বেশ প্রশংসিত হচ্ছে।

আল- আমিন নামের আরেকজন দর্শক বলেন,‘আমরা তো মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সৃষ্টিলগ্ন ও তারও পূর্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো দেখিনি। এই চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে সেসব ইতিহাস অক্ষুন্ন রেখে খুবই নিঁখুতভাবে সেগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে আমাদের প্রাণের নেতাকে আরো ভালোভাবে জানার, বোঝার সুযোগ সৃষ্টির জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

লতিফা রহমান নামের একজন বলেন,‘ আমরা তো মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মানুষ। তাই চলচ্চিত্রটি কেবল আমাদের জন্য নিছক একটি চলচ্চিত্র নয়। এটি একটি আবেগ আমাদের জন্য। কারণ সময়টার মধ্য দিয়ে আমরা গেছি। চলচ্চিত্রটি দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে এটি একটি অনবদ্য সৃষ্টি এবং এটির ভীষণ প্রয়োজন ছিলো। বিশেষ করে তাদের জন্য যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, নেতা মুজিবকে, ব্যক্তি মুজিবকে দেখেননি।’

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী মূলক চলচ্চিত্র ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’। শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় ছবিটি গতকাল ১৩ অক্টোবর দেশের রেকর্ডসংখ্যক ১৫৩টি হলে একযোগে মুক্তি পেয়েছে। চলচ্চিত্রটির সহকারী পরিচালক দয়াল নিহালনি। চিত্রনাট্য লিখেছেন অতুল তিওয়ারি এবং শামা জাইদি। চলচ্চিত্রটির নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন নুজহাত ইয়াসমিন।

সিনেমাটি মুক্তির আগে এর দুটি বিশেষ প্রদর্শনী হয়, যার একটিতে অংশ নিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যটিতে অংশ নিয়েছিলেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। আসাদুজ্জামান নূরের তত্ত্বাবধানে সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে। এতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ।

বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ ও ভারতের ৪০ শতাংশ ব্যয়ে নির্মিত এই বায়োপিকের শুটিং ২০২১ সালের ২২ জানুয়ারি মুম্বাই ফিল্ম সিটিতে শুরু হয়ে একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে শেষ হয়।

এতে তরুণ বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনেতা দিব্য জ্যোতি এবং বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসার চরিত্রে অভিনয় করেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। এছাড়াও ছিলেন প্রার্থনা ফারদিন দীঘি, ফজলুল রহমান বাবু , চঞ্চল চৌধুরী, তৌকির আহমেদ, দীপক অন্তানি, রিয়াজ,খায়রুল আলম সবুজ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, জায়েদ খান, নুসরাত ফারিয়া, তুষার খান, দিলারা জামান, সাবিলা নূর, রোকেয়া প্রাচী, এলিনা শাম্মী, একে আজাদ সেতু, সিয়াম আহমেদ প্রমুখ।