মুজিব কোটের ভিতর ওরা কারা

আবদুল মান্নান »

এই উপমহাদেশে কোন কোন পরিধেয় বস্ত্রের সাথে বিশেষ কোন ব্যক্তির নাম যেমনটা জড়িত হয়ে আছে তা অন্য কোন দেশে দেখা যায় না। পাকিস্তান আমলে জিন্নাহ টুপি বেশ প্রচলিত ছিল। যদিও জিন্নাহর সাথে ইসলাম বা নামাজ কালামের কোন সম্পর্ক ছিল না তথাপি তিনি নিজেকে মুসলমানদের খলিফা প্রমাণ করার জন্য আনুষ্ঠানিক লেবাস হিসেবে বাছাই করেছিলেন শেরওয়ানি ও পশমের তৈরি এক ধরণের টুপি। পোশাক নির্ধারণ হয় সাধারণত আবহাওয়া ও কৃষ্টি দ্বারা। এক সময় আমাদের বাপ দাদাদের অনেকেই ধুতি পরতেন। তারা খুবই পরহেজগার মানুষ ছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকাত আলি খান গোলাকৃতির পশমের টুপি পরতেন। একে বলা হতো লিয়াকত ক্যাপ । মহাত্মা গান্ধি যৌবনে কাপড়ের বানানো কিস্তি টুপি পরতেন। তার নাম হলো গান্ধি টুপি। বাংলাদেশের প্রথম সেনাশাসক জেনারেল জিয়া সাফারি স্যুট চালু করেছিলেন। তবে তা তার নাম ধারণ করেনি। তবে মানুষ কোন ব্যক্তিকে এই স্যুট পরা অবস্থায় দেখলে ধরে নিত তিনি নির্ঘাত বিএনপি’র সমর্থক। বাস্তবে তেমনটি নাও ঘটতে পারে । জওহর লাল নেহেরু কাপড়ের বানানো হাত কাটা কোটি পরতেন তাঁর কুর্তার উপর, নাম হলো জওহর কোট। বঙ্গবন্ধু শেরওয়ানি, স্যুট পরেছেন এক সময়। বঙ্গবন্ধুর শারীরিক গঠনের কারণে তিনি যাই পরতেন তাই তাঁকে মানাতো । ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার বাঙালি তেমন একটা দেখা যায় না। বঙ্গবন্ধু ঠিক ওই মাপের ছিলেন। এই পর্যন্ত বিশ্বের কোন নেতা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে উচ্চতায় বেশি তেমনটি দেখা যায়নি। তাঁর সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হলে উপরের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হতো।
অনেকটা ষাটের দশক হতে বঙ্গবন্ধুর পরিধেয় বস্ত্রে পরিবর্তন আসা শুরু হয়। তিনি ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, তার ওপর কালো জওহর কোট আর গলায় চাদর পরা শুরু করলেন। এই বস্ত্রই তাঁর নিত্যদিনের কাপড় হয়ে গেল । জওহর কোট পরিণত হলো মুজিব কোটে। এই ধরণের কোট উপমহাদেশে এখনো বেশ পরিচিত । পাকিস্তানে একই ধরণের কোট পরেন রাজনৈতিক নেতারা । ভারতে এই কোটকে বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছেন নরেন্দ্র মোদি । বাংলাদেশেও অনেক জায়গায় দেখেছি তাকে মোদি কোটও বলা হয় । তবে মুজিব কোর্ট যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা অন্য কোন কোট বা বস্ত্র পায়নি। এটি হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তার কারণে। অনেকে মনে করেন তারা যদি বঙ্গবন্ধুর আদলে এই কোট বা তাঁর মতো কাপড়চোপড় পরেন তাহলে মানুষ বুঝি তাকে বঙ্গবন্ধুর একজন বড় মাপের সমর্থক মনে করবেন, এক আধটু সম্মান করবেন। নির্বোধরা বুঝতে অক্ষম কাপড় দিয়ে মানুষের চরিত্র ঢেকে রাখা যায় না, কাপড়ের ভিতরের মানুষটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ । বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে যারা জড়িত ছিলেন বা যারা তাঁর লাশ ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের সিঁড়িতে রেখে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নিতে গিয়েছিলেন তারা অনেকেই নিত্যদিন বঙ্গবন্ধুর আদলে পোশাক পরতেন, তাঁকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতেন ।
লোপা তালুকদার নামে কাউকে চিনতাম না। শিশু অপহরণের দায়ে পুলিশ তাকে ফতুল্লা থেকে গ্রেফতার করলে লোপা সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় । অভিযোগ আছে, লোপা জিনিয়া নামের এক ছোট শিশুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি এলাকা হতে বদ মতলবে ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল । জিনিয়া ওই এলাকায় ফুল বিক্রি করতো । পুলিশ জিনিয়াকে উদ্ধার করে আর লোপাকে গ্রেফতার করে। লোপা নিজেকে আওয়ামী পেশাজীবী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দেয়। সাংবাদিক হিসেবেও তার একটি পরিচয় আছে । এই পরিচয়ে একটি পুরস্কারও পেয়েছিল লোপা। বিগত বেগম জিয়ার সরকারের সময় লোপা আর তার রাজাকার পিতার বিরুদ্ধে জোড়া খুনের মামলা হয়েছিল । ২০১৩ সালে এই মামলা সরকারের বিশেষ কমিটির মাধ্যমে রাজনৈতিক মামলা বলে প্রত্যাহার করা হয়। বেশ চতুর মহিলা লোপা তালুকদার। পত্রিকায় তার যে ছবিটা প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে লোপার পরনে একটি বেশ জুতসই মুজিব কোট, বাম পাশে লাগানো একটি নৌকার প্রতীক, যা স্বর্ণের নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি । বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে কখনো এমন পোশাক পরতে দেখা যায়নি ।
লোপা একটি স্যাম্পল মাত্র । গত বছর দু’এক ধরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যত রকমের অপকর্ম হচ্ছে তা অতীতে কখনো দেখা যায়নি । জামিদখল, মার্কেট দখল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দখল কোন কিছুই বাদ যাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পর পর তিনবার সরকার প্রধান। উন্নয়নশীল বিশ্বের কোন রাজনৈতিক দল একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে তেমনটি ঘটতে দেখা যায় । দলের ছত্রছায়ায় অনেক আগাছা পরগাছা দলে ঢুকে পড়ে, কেউ কেউ নানা ছিদ্র দিয়ে দলের পদপদবি বাগিয়ে নেয় তারপর উই পোকার মতো দলকে কুরে কুরে খায় । দীর্ঘ সময়ে দল হয়ে পড়ে দুর্বল । এক সময় জনগণ বিকল্প চিন্তা করে ।
কদিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশন এক আলোচনা অনুষ্ঠান করলো যার শিরোনাম ছিল ‘রাজনীতির অচিনপুর, ফরিদপুর’। শিরোনামটি বেশ চমকপ্রদ । অনেক দিন ধরে তথাকথিত হাতুড়ি বাহিনী আর হেলমেট বাহিনীর অত্যাচারে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা চরম বিপর্যয়ের সম্মূখীন। এই বাহিনী স্থানীয় এক লীগ নেতার ছত্রছায়ায় তাদের কর্মকা- পরিচালনা করে বলে খবরে প্রকাশ। দখল আর দখল আর বেপরোয়া চাঁদাবজিসহ এমন কোন অপকর্ম নেই যার সাথে তাদের সম্পর্ক নেই। তারা সকলে মুজিব কোট পরে এই সব অপকর্ম করছে বেশ কয়েক বছর ধরে। আমি একজন আলোচক ছিলাম । শুরুতে বলি ফরিদপুর নিয়ে এমন একটা আলোচনা করতে হবে তা অচিন্তনীয়, কিছুটা বিব্রতকরও বটে। এই ফরিদপুরে জাতির জনক ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার জন্ম (গোপালগঞ্জ তখন ফরিদপুর জেলার মহকুমা)। এই জেলা আওয়ামী লীগের দুর্ভেদ্য দুর্গ । এই কারণেই এখানে আওয়ামী লীগের নামে মুজিব কোট পরে দূর্বৃত্তদের আস্ফালন অনেকটা সহজ। তবে স্বস্তির কথা হলো কিছুদিন আগে থেকে ফরিদপুরে দূর্বৃত্ত দমন শুরু হয়েছে এবং সকলের ধারণা তা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কারণে। এখন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া কোন কিছ্ইু হয় না বলে সাধারণ মানুষের ধারণা ।
সদ্য সমাপ্ত সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, তারা যেন কোন অপরাধীদের বাঁচাতে না আসেন । এই হুশিয়ারি, প্রয়োজন ছিল কারণ দেখা যায় যখনই কোন বড় মাপের দলীয় লেবাসধারি দুর্বৃত্ত ধরা পরে তখনই তাকে রক্ষা করার জন্য দলের কেউ না কেউ এসে পড়ে। সরকারি কর্মচারি লেবাসধারি দুর্বৃত্তদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য । টেকনাফে মেজর(অব.) সিনহা হত্যাকা-ের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক হলো ওসি প্রদীপ দাশ ও এস আই লিয়াকত । তাদের রিমান্ড চলাকালে দেখা গেল প্রিজন ভ্যান হতে দু’জনই তাদের কোন এক স্যারের সাথে ফোনে কথা বলে রিমান্ড কালে তাদের ওপর কথিত অত্যাচারের অভিযোগ করছেন । প্রশ্ন হচ্ছে এই স্যার কে ? নিশ্চয় বিরোধী দলের কেউ না । এখন পর্যন্ত সেই ‘স্যারে’র নামতো জানা গেল না । পুলিশের পক্ষে তা বের করা তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। মুজিব কোট ধারী কেউ কোন অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে ধরা পড়লে তখন কোন কোন নীতিনির্ধারককে প্রায়শ দুটি বাক্য বলতে শোনা যায় । ‘বরদাস্ত করা হবে না’ আর ‘যেই হোক ছাড় দেয়া হবে না।’ কিন্তু এই সব দূর্বৃত্তরা দলে কি ভাবে ঠাঁই পেল তা কি কখনো জানার চেষ্টা করা হয়েছে ? শাহেদের মতো এত বড় মহা বাটপার দলে ঢুকে দীর্ঘদিন কি ভাবে দাপিয়ে বেড়ালো তা কি কখনো জানা যাবে? সম্ভাবনা কম। ক্যাসিনো কর্মকা-ে জি কে শামিম বা সম্রাট আটক হলে শুরুতে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সে কি হুঙ্কার। শেখ হাসিনার পাল্টা হুশিয়ারিতে সব চুপ। বাস্তবতা হচ্ছে এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের কাছে এটাই বিশ্বাসযোগ্য যে, চলতি শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে যদি আওয়ামী লীগকে দুর্বৃত্তমুক্ত করা যায়, তা সম্ভব একমাত্র শেখ হাসিনার দ্বারা কারণ তিনবার লাগাতার সরকার প্রধান থাকার পর তাঁর আর কোন কিছুরই চাওয়ার নেই। তিনি যে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন তা কারো পক্ষে অতিক্রম করা সহজে সম্ভব নয় ।
হেফাজতে থাকা একজন নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার দায়ে প্রথমবারের মতো তিনজন পুলিশ সদস্যকে আদালত যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করার পর দেশে আইনের শাসনের প্রশ্নে মানুষ আরো একটু আশান্বিত হয়েছে। এটিও সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অন্যায়ের প্রতি জিরো টলারেন্সের কারণে । প্রধানমন্ত্রীর এই চিন্তাধারা বজায় থাকবে মানুষ তেমনটাই আশা করে । তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির দায়ে মন্ত্রি সভার সদস্য সহ তেইশ জন সংসদ সদস্যকে দল হতে বহিষ্কার করেছিলেন । সেই পিতার রক্তইতো তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত । শেখ হাসিনা জীবনে হারিয়েছেন অনেক তবে পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা ।
কিন্তু তাঁর সকল অর্জন আর প্রাপ্তিকে মলিন করে দেয়ার জন্য অনেকেই মুজিব কোটের ভেতর ঢুকে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন । যারা তাঁকে ভালবাসেন তাদের ধারণা তাঁর কিছু কাছের মানুষ তাঁর চারপার্শ্বে একটি অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যা একমাত্র তিনিই ভাঙ্গতে পারেন। তিনি তাদের চেনেন । কাছের আর দূরের দুবৃর্ত্তদের দাপট চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে পারলে শেখ হাসিনার সাফল্যের টুপিতে আরো একাধিক পালক শোভা পাবে । ক’দিন পর শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিন। বাংলার মানুষের পিতার শতায়ু দেখার সৌভাগ্য হয়নি । কন্যার শতায়ু কামনা করছি । জন্মদিনে আগাম শুভেচ্ছা ।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক