মাধবী তোর সমস্ত কথা

চৌধুরী শাহজাহান :

মাধবী আর একটু বসো। কতোদিন পরে দেখা। তোমার মনে আছে- আমরা ক্লাস শেষে কয়েকজন বন্ধু মিলে কলাভবনের শিউলিতলায় আড্ডায় মেতে থাকতাম। তুমি কথা শুরু করলে আর থামতে চাইতে না। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবার গল্প। এমন কোনো বিষয় ছিল না যা  তোমার গল্পে আসতো না। কখন যে স্রোতের মতো সময় বয়ে যেতো টেরই পেতাম না। রবীন্দ্রসংগীত তোমার খুব প্রিয়। রবিঠাকুরের ‘আমার পরাণ যাহা চায়’ কিংবা ‘দিবস রজনী আমি  যেন কার আশায় আশায় থাকি’সহ আরো কত গান তোমার গলায় অসাধারণ মুগ্ধতা ছড়াতো। আধুনিক গানের গলাও ভালো। দীর্ঘদিন গান শিখেছো আর্যসংগীতে। বেশকিছু পুরস্কারও আছে তোমার ঝুলিতে।

একদিন হঠাৎ বললে তোমার মা-বাবা তোমার বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে একটি কলেজে অধ্যাপনা করে। মাস্টার ছেলে স্বামী হিসেবে তোমার পছন্দ না। তোমার ধারণা, স্বামী শিক্ষক হলে বাকি জীবনও ছাত্রী হয়ে থাকতে হবে। তোমার বাবাও কলেজে শিক্ষকতা করেন, সেটাও জানালে। এদিকে আমিও বেকার। মাস্টার্স পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি। আমি ভেবে পাচ্ছি না, কি করা যায়। দেখলাম খুব টেনশন করছো। বিষণœতা তোমাকে ঘিরে ফেলেছে। মুখের হাসি উধাও। কিছুক্ষণ আমার হাত ধরে নীরব হয়ে বসে রইলে। কি যেন আরও বলতে চাইলে। কিন্তু বলতে পারছো না। না বলতে পারার বেদনা অনুভব করলাম।

তোমার মাথায় হাত রেখে বললাম, ‘চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

দেখলাম, তোমার দুচোখ বেয়ে শ্রাবণের বন্যা নামছে। বাঁধভাঙা। কিছুতেই থামছে না।

অনেক দিন পর ক্যাম্পাসে এলে। প্রায় এক সপ্তাহ পর। অনেকটা নির্ভার মনে হলো। বেশ উচ্ছল। নীলাম্বরী শাড়ি পরেছো আজ। যা সুন্দর লাগছে তোমাকে। যেন আকাশের নীলপরি আমার সম্মুখে নৃত্যের তালে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করছে।

জানতে চাইলাম, কেমন আছো।

বললে, খুব ভালো। বাবা আমার বিয়ে ক্যানসেল করে দিয়েছেন। বলেই হা হা হা করে একটা সুন্দর হাসি উপহার দিলে। বাবাকে বললাম, অনার্স পাসের আগে আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না। বাবা অনেক্ষণ চিন্তা করে বললেন, তোমার অমতে কিছুই হবে না। মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো বলে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন।

মাধবী আরো বললো, ‘আজ আমার আনন্দের দিন। আমরা দুজন সারাদিন ঘুরে বেড়াবো। চলো, ফ’য়স লেকে যাই। অনেকদিন যাই না। দুপুরের খাবার শেষ করে বিকেলে আড্ডা মেরে সন্ধ্যায় শিল্পকলায় নাটক দেখবো। তারপর বাসায় ফিরবো। সকালে মাকে বলে এসেছি। বলেছি,  শীলাদের বাসায় যাবো। সো নো টেনশন।’

সময় বয়ে যায় সময়ের নিয়মে।  তুমি অনার্স পাস করলে। আমিও মাস্টার্স শেষ করলাম। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে চাকরির সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়াচ্ছি। হবে-হচ্ছে করেও চাকরি হয় না। তোমার দিক থেকে কোনো তাড়া ছিলো না। তুমি চাও আমি আগে স্বাবলম্বী হই। তোমার অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। ছোট্ট একটি টিপটপ সংসার হবে। বিয়ের পর হানিমুনে থাইল্যান্ড যাবে। তারপর বালিদ্বীপ ঘুরে প্রাচীন ঐতিহ্য দেখবে। আরো কত কিছু। স্বপ্নে মানুষ কত কিছুই না দেখে। মানুষ স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করে আনন্দ পায়।

দুবছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর চাকরিটা সত্যি আমার হয়ে গেল। বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডারে। তুমি খুশিতে আত্মহারা। একগুচ্ছ লালগোলাপ হাতে দিয়ে কিছুক্ষণ অপলকনেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে। তারপর বললে, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি, আকাশ। চেষ্টা করলে তুমি অনেক বড় কিছু হবে।’ মৃদু আলিঙ্গন দিয়ে কিছুক্সণ পাঁজরে জড়িয়ে রাখলে। আমার দেহে কিঞ্চিৎ ভূকম্পনের মতো কিছু একটা হয়ে গেল। কি এক ভালোলাগার পরশ!

জানি এ বাক্যটি তুমি পূর্বে বহুবার বলেছো। তারপরও ভালো লাগলো। তোমার ভালোবাসা আর উৎসাহ ছাড়া আমি এতদূর পথ একা একা পাড়ি দিতে পারতাম না। তোমার ভালোবাসায় মুগ্ধ আমি,  হে প্রিয়তমা।

তারপর আমরা পারিবারিক সম্মতিতে শুভদিন দেখে ধুমধাম করে বিয়ে করলাম। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন সবাই আনন্দ করলো। শুরু হলো টুনাটুনির নতুন জীবন। এবার একে একে স্বপ্নপূরণের পালা শুরু হলো।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। আমাদের নবসংসার, সুখের শেষ নেই। হঠাৎ শীলা এসে সুখের সংসারে আগুন দিলো। মাধবী কোনোভাবেই তাকে সহ্য করতে পারছে না। মাধবীর সহপাঠী শীলা। সেকেন্ড ইয়ারে বিয়ে করে এক ডাক্তারকে। কোনো কারণে ডাক্তারের সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছে না। ডাক্তার শীলাকে সময় দেয় না। সে তার পেশাকেই ভালোবাসে। তাই তার সংসারে অশান্তি আর অশান্তি। এসব কথা সে প্রায়ই ফোনে আমাকে বলতো। কখনো হোয়াটসআপ বা  মেসেন্জারে লিখে জানাতো। মাধবী প্রথম দিকে কিছু মনে না করলেও পরে এটাকে মেনে নিতে পারলো না। পছন্দ করলো না বিষয়টাকে। একজন বিবাহিত নারী তার বরের সাথে ইটিসপিটিস করুক কোনো নারীই বোধ হয় সহজভাবে তা মেনে নেয় না। যতই সে নিকটজন হোক।

বিয়ের আগে আকাশ মাধবীকে নিয়ে বেশ কয়েকবার শীলাদের বাসায় গিয়ে আড্ডায় মেতেছিল। কখনো শীলার মধ্যে আকাশরাগ-অনুরাগ দেখেনি। বহুবার মাধবীর সুবাদে শীলার সঙ্গে দেখাও হয়েছে। কিন্তু তার মনের গোপনবাসনা ব্যক্ত করেনি। আজ এতো বছর পর কি হলো? তাহলে কি  সে আগে থেকেই আকাশকে পছন্দ করতো! ওয়ান সাইডেড লাভ! যা কখনো সে প্রকাশ করেনি। এখন সুযোগ বুঝে প্রকাশ করলো।  ব্যাপারট নিয়ে মাধবীর সাথে আমার মনোমালিন্য চরমে উঠলো। উটকো ঝামেলা। শীলাকে নিয়ে সংসারে নানা অশান্তি। মাধবী ভাবতেই পারছে না, শীলা আকাশকে প্রমের দৃষ্টিতে দেখবে।

মাধবীকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। মানুষের মন বহুবিচিত্র। কার চিন্তায় কী আছে বুঝা মুশকিল। যারা গৃহবন্দি, একাকী জীবনযাপন করে তারা বিষণœতায় ভোগে বেশি। অনেক সময় সিজোফ্রেনিয়ায় ভোগে। হয়তো ওর বেলায়ও তাই হয়েছে। কিংবা ঈর্ষাও জাগতে পারে। কেউ সুখে থাকলে মানুষ ঈর্ষাবোধ করে। এ তো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।

আমি তোমাকেই ভালোবাসি। বিশ্বাস করো মাধবী। পৃথিবীতে শুধুমাত্র একজন নারীকেই আমি ভালোবাসি আর তা তুমি। শীলা তোমার বন্ধু। সে হিসেবে আমারও বন্ধু। এর বেশি কিছু নয়। তুমি যদি না চাও, আমি তার সাথে কথা বলবো না। সংসারে অশান্তি করে কি লাভ? তাছাড়া এটা আমাদের উভয়েরই মান-সম্মানের ব্যাপার।

মাধবীলতার সঙ্গে কখন আমার দেখা হয়েছিল তার দিনক্ষণ ঠিক মনে নেই। তবে এটুকু মনে পড়ে প্রথম দেখাতেই মাধবীলতাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। কী যে চাপারূপ ছিল ওর। তখন আমার  সোনালি যৌবন। ঘর-সংসার বুঝি না, আমি বুঝি তখন শুধু রঙিন এক পৃথিবী। কতদিন দূর থেকে  দেখেছি, কতদিন কাছ থেকে দেখেছি মাধবীলতাকে। কী যে স্নিগ্ধতা তার। কতবার ফিরে ফিরে  দেখেছি, কে রেখেছে তার হিসাব। সে থাকতো শামসুন নাহার হলে। আমি থাকতাম আলাওলে ।  গোধুলি আসন্ন হলে বের হতাম দক্ষিণ ক্যাম্পাসের দিকে। বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকাটা চমৎকার। সুনসান। বিকেলে আরো অনেক জুটি দেখতে পেতাম চুটিয়ে প্রেম করছে। জোড়ায়  জোড়ায়। আমার মনেও সাহস বেড়ে গেল। মাধবী আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতো।

সে কানে কানে বললো, ওই, তুমি কি আগে কখনো এখানে এসেছো?

আমি বললাম, না, না। কখনো না। এই প্রথম তোমাকে নিয়ে এলাম।

আগে বড় ভাইয়াদের মুখে অনেক গল্প শুনেছি। তারাও এখানে এসে প্রিয়জনদের নিয়ে সময় কাটাতো। সেখানে একটি প্রাকৃতিক লেক আছে। চারদিকে ফুলফল আর বাহারি গাছে একটি মনোরম পরিবেশ। পদ্মফুল ফুটে থাকতো থরে-বিথরে। দুজনে খুনসুটি করে কত সময় যে পার করেছি তার কোনো হিসেব নেই। শহরের অলিগলি কারণে-অকারণে কত যে হঁটেছি। মাধবীকে বললাম, সেসব দিনের কথা তোমার মনে আছে? সেই যে সোনাঝরা দিনগুলো।

মাধবী বললো, আলবত মনে আছে। তোমার কি মনে আছে আমাদের প্রথম পরিচয় কিভাবে হয়েছিল?

আমি বললাম, না।

তুমি বললে-শার্টল ট্রেনে।

দেড়টার ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। শহরে জরুরি প্রোগ্রাম। না গেলেই নয়। আমি দৌড়াচ্ছিলাম ট্রেন ধরার জন্য। তুমি ছিলে পাদানিতে। আমাকে সাহস দিয়ে বললে, আমার হাত ধরুন। আমি ইতস্তত করছিলাম। বললে, লজ্জার কিছু নেই। তোমার মুখ-কান রক্তিম হয়ে উঠলো। প্রথম দেখাই নাটকীয়। রোমাঞ্চকরও বটে। হা হা হা …

তুমি ব্যাখ্যার সুরে বললে, আপনার হাত ধরা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলো না। কারণ বিকেলে আমার গানের শো ছিল শিল্পকলায়। ঢাকা থেকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মিতা হকসহ নামী  শিল্পীরা আসবেন।

আমি তোমাকে সেদিন অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে দিয়েছিলাম, মনে পড়ে।

তোমাকে বেশ একসাইটেড মনে হলো। একটু শিহরিতও। তুমি মৃদু হেসে চুপ করে রইলে। তারপর আমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হলাম। আমি লোকপ্রশাসন আর তুমি ইংরেজিতে। বয়সের দিক থেকে আমরা খুব কাছাকাছি। স্মৃতি তুমি সতত মধুর।

স্মৃতি হাতড়ে তুমি বললে, জানি তুমি আমাকে প্রচ- ভালোবাসো। একজনমে তুমি ছাড়া আমার  কেউ নেই। পরিচয়ের পর থেকে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভাবিনি। আমার আকাশে তুমিই একমাত্র ধ্রুবতারা।

মাধবীকে বললাম, মাধবীলতার মতো তুমি মিশে আছো আমার অস্তিত্বে। এ হৃদয় শুধু তোমারে চায়, প্রিয়তমা। নিশ্বাসে তুমি, পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে তুমি। তুমিহীনা বিশ্ব আমার বিমর্ষ, ঝড়ো মরুভূ।ি শীলা মিলা ডেলা বলতে আসলে আমার কেউ নেই। বুঝলেন ম্যাডাম। আমি শুধু  তোমাকে চাই, শুধু তোমাকে।

তুমি হেসে বললে, আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি, তুমি অবসর মতো বাসিও …