মাতারবাড়িতে প্রথম পণ্যবাহী জাহাজ

দেশের জন্য ‘বিশেষ মাইলফলক’ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার :
প্রথমবারের মতো মহেশখালী মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্রবন্দরে জেটিতে ভিড়েছে পানামার পতাকাবাহী প্রথম বাণিজ্যিক জাহাজ ‘ভেনাস ট্রায়াম্প’। সরকার কক্সবাজার জেলার দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়িতে এ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে মালবাহী এই জাহাজটি অবতরণ করানো হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টা ২০মিনিটে ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা জাহাজটি মাতারবাড়ির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্মিত জেটিতে প্রবেশ করে। বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম বন্দরের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন জহিরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় হওয়ায় মাতারবাড়ির গভীর সাগরে পৌঁছানোর পর চ্যানেল ধরে জাহাজটিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেটিতে নিয়ে যান চট্টগ্রাম বন্দরের পাইলটরা। বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, মাতারবাড়ি চ্যানেলে এটিই প্রথম পণ্যবাহী জাহাজ। জাহাজটির ক্যাপ্টেন আতাউল হক সিদ্দিকি সাংবাদিকদের বলেন, এই জাহাজটির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের ফিজিক্যাল অপারেশনটা মাতারবাড়িতে শুরু হলো। চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনায় এটি একটি টেস্ট ট্রায়াল হিসেবে আসলো। পরবর্তীতে কোল পাওয়ারের সব জাহাজ এভাবে আসতে থাকবে। আমরা আশা করছি পরবর্তীতে এখানে বাণ্যিজিক জাহাজও ভিড়বে এবং এটি একটি ডিপ সি পোর্ট হিসেবে পরিচিত হবে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, কাজ শুরু হয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর বন্দর নির্মাণকাজ। যন্ত্রপাতিসহ পর্যাপ্ত জনবল নিযুক্ত করে এই বন্দরের কাজ চালানো হচ্ছে। দ্রুতগতিতে কাজ চালিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের কাজ নির্ধারিত সময়ের সম্পন্ন করা হবে।
জানা গেছে,‘ভেনাস ট্রায়াম্প’ জাহাজটি ২২ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার পেলাভুবন সিলেগন বন্দর থেকে মাতারবাড়ির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ নিয়ে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। জাহাজটি ২০০৯ সালে নির্মিত একটি জেনারেল কার্গো শিপ। এটি ১২০ মিটার লম্বা ও ৯ হাজার ৬৮০ টন ওজন ক্ষমতাসম্পন্ন।
দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট মাতারবাড়ি সুপার-ক্রিটিকেল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করছে। পরীক্ষামূলকভাবে সরাসরি মালবাহী জাহাজ নোঙর করানো বাংলাদেশের জন্য একটি ‘বিশেষ মাইলফলক’ বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বর্তমানে সময় সাপেক্ষ, বাস্তবসম্মত ও টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গত ১১ বছরে ১৮ হাজার ৬০৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১১৩টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে এবং দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে।
মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান।
বাকি অর্থের মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে। এর সব নকশা জাপানি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে।
এই প্রকল্পের অধীনে সংযোগ সড়কসহ গভীর সমুদ্র বন্দরে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার দীর্ঘ দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এর ফলে বড় জাহাজ থেকে সরাসরি পণ্য ওঠানামা সহজ হবে।
প্রাথমিকভাবে মাতারবাড়িতে একটি কনটেইনার টার্মিনাল এবং একটি বহুমুখী পণ্য ওঠানো-নামানোর টার্মিনাল হবে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন বাড়ার সঙ্গে এই বন্দরের কার্যক্রমও ধারাবাহিকভাবে বাড়বে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর এ সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাপানি প্রতিষ্ঠান ‘নিপ্পন কোয়ে’র সঙ্গে চুক্তি সই হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৪০ নটিক্যাল মাইল দূরে মাতারবাড়ির এই প্রকল্প এলাকা। ১৮০ মিটার চওড়া চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল দিয়ে বর্তমানে সাড়ে নয় মিটার ড্রাফটের জাহাজ চলাচল করতে পারে।
আর ১৪ দশমিক পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ, ২৫০ মিটার চওড়া এবং সাড়ে ১৮ মিটার গভীরতার (ড্রাফট) মাতারবাড়ি চ্যানেল দিয়ে আট থেকে ১০ হাজার কনটেইনার পরিবহনের উপযোগী জাহাজ ভেড়ানো যাবে বন্দরে। ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজও সেখানে ভিড়বে। ২০২৬ সালের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।