বৃক্ষ ধরণীতে নিঃস্বার্থ, পরম ও উপকারী বন্ধু

সাধন সরকার »

সম্প্রতি মুজিববর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে সারা দেশে ১ কোটি চারা বিতরণ, রোপণ ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনগণকে বৃক্ষরোপণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বৃক্ষরোপণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ধরণীতে নিঃস্বার্থ, প্রকৃত ও উপকারী বন্ধু হলো বৃক্ষ। বৃক্ষের ছায়াতলেই গড়ে উঠেছিল মানবসভ্যতা। তাই বৃক্ষ ছাড়া মানুষের অস্বিত্ব কল্পনা করা যায় না। এককথায় বৃক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে জড়িত। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাসহ নৈসর্গিক শোভাবর্ধনে বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম।
পরিবেশের দূষণ রোধ ও বৈশি^ক উষ্ণতা কমাতে গাছ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখে থাকে। অথচ নগরায়ণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর যন্ত্র-প্রযুক্তির মোহে অযাচিতভাবে বৃক্ষনিধন করা হচ্ছে। উজাড় হচ্ছে বন। ফলে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বাড়ছে উষ্ণায়ন আর মানবসভ্যতা পড়ছে হুমকির মুখে। দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণের মতো সামাজিক আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মাঝে। শুধু জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান বা বৃক্ষমেলার সময় নয়, নিজ নিজ উদ্যোগে প্রত্যেক সচেতন মানুষকে সময়-সুযোগ বুঝে বৃক্ষরোপণে এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে হতে হবে বৃক্ষপ্রেমিক! বিশেষ বিশেষ দিনগুলোকে উপলক্ষ করে বৃক্ষরোপণ করলে সেটা ভালো কাজ দেবে। যেমন সেটা হতে পারে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ জন্মদিনে, সন্তানের জন্মদিনে, সন্তানের প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন, বিবাহবার্ষিকীতে, বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে, পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের নামে,পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনে বা অন্য কোনো বিশেষ কারণে।
পরিবেশের দূষণ ও বিপর্যয়সহ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশে^র প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। এখন জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে চিরচেনা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ঋতুর বিশৃঙ্খল আচরণ প্রকৃতিকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশকে উপেক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়! মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের কয়েক হাজার একর বনভূমি ইতিমধ্যে উজাড় হয়েছে! এ ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ে জমি অধিগ্রহণ, অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিদ্যুকেন্দ্র নির্মাণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়নে বনভূমি কমে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আরও পরিকল্পনা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা পাবে।
বাংলাদেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। সরকারি হিসেবে বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৭ শতাংশ বলা হয়ে থাকে! বিভিন্ন জরিপে দেশে প্রাকৃতিক বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়ার খবর পাওয়া গেলেও প্রাকৃতিক বনের বাইরে অর্থাৎ সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। মানুষের সচেতনতা, কমিউনিটি উদ্যোগ এবং সরকারের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির কারণে লোকালয়ে গাছের সংখ্যা বাড়ছে। ‘এসডিজি’তে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ২২ শতাংশের বেশি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এমন সব প্রশংসনীয় ও সামাজিক আন্দোলন অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জন সহজ হবে। দূষণের দিক দিয়ে ঢাকা শহর সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে এবং বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হলো এর সবুজায়ন। নগরের সৌন্দর্য বাড়াতে এবং প্রায় দুই কোটি মানুষের প্রাণভরে নিশ^াস নেওয়ার জন্য বিভিন্ন পার্কে-উদ্যানে, সড়কের চারপাশে, নদী কিংবা খালের পাশে ও বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগাতে হবে।
প্রকৃতি ও পরিবেশ ভালো থাকার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের টিকে থাকা। আমাদের নিজেদের স্বার্থে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করতে হবে। আমাদের দেশের প্রকৃতি বৈচিত্রময় এবং অনেক সম্পদে ভরপুর। নদ-নদী, খাল-বিল, পাহাড়-বন, হাওর-বাওর, মাটি আর বায়ু মিলিয়ে এক অপূর্ব প্রকৃতির সমারোহ।
পরিবেশের অবক্ষয় রোধে ও দারিদ্র্য বিমোচনে বৃক্ষরোপণ ব্যাপক সহায়ক। বৃক্ষ মানুষের পরম ও প্রকৃত বন্ধু। বৃক্ষ মানুষকে মহৎ করে তোলে, শুদ্ধতা অর্জনের জন্যও বৃক্ষমুখী হওয়ার বিকল্প নেই! দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশু-কিশোরদের যদি বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন দেশ ভরে উঠবে সবুজে সবুজে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বৃক্ষরোপণের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। গাছ লাগানোর এখনই (জুলাই-আগস্ট) উপযুক্ত সময়। দেশের ছোট-বড় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, রেললাইন ও সড়কের পাশে, সরকারি-বেসরকারি অফিস, রাস্তার দুই পাশে, পতিত ও খাস জমিতে, উপকূলীয় এলাকায়, গৃহের আঙিনায় ও বাড়ির ছাদসহ অন্যান্য জায়গায় ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। দরকার শুধু চষ্টা ও রক্ষণাবেক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ। প্রাকৃতিক বন বৃদ্ধি, সংরক্ষণ ও টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি সামাজিক ও গৃহস্থালি বনায়নের প্রতি আরও জোর দিতে পারলে বনভূমির পরিমাণ ২৫ শতাংশে আনা অসম্ভব নয়। লোভ-লালসা আর অর্থের লোভে বৃক্ষ, পাহাড়, কৃষিজমি, বন, কাটতে কাটতে আর মাটি, পানির দূষণ ত্বরান্বিত হতে হতে এমন এক সময় আসবে যখন থাকবে শুধু টাকা, যে টাকা দিয়ে তখন আর নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রকৃতি ও পরিবেশ ফেরত পাওয়া যাবে না। এটা আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃতিকে আমরা যেমনটা দেবো অনুরূপভাবে প্রকৃতিও আমাদের তেমনটাই ফেরত দেবে।

লেখক : পরিবেশকর্মী

[email protected]