বিড়ি-সিগারেট উৎপাদন বন্ধের প্রস্তাব নাকচ শিল্প মন্ত্রণালয়ে

বিবিসি বাংলা :

বিড়ি সিগারেটসহ সব ধরণের তামাক কোম্পানির পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি সাময়িকভাবে বন্ধ করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের দেয়া একটি প্রস্তাব বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয় নাকচ করে দিয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো ওই প্রস্তাবের ব্যাপারে বুধবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে আলোচনার পরে তামাকজাত পণ্যের বিক্রি বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আবদুল হালিম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”এটা একটা শিল্প, এখানে প্রচুর লোকজন কাজ করছে। সুতরাং এখান থেকে অন্যদিকে শিফট করতে গেলে, সময় নিয়ে নিয়ে, কৌশল ঠিক করে সেটা করতে হবে। এই শিল্প কোথায় যাবে, লোকগুলো কোথায় যাবে – সেটা একটা সময়ের ব্যাপার।”

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পাল্টা চিঠিতে শিল্প মন্ত্রণালয় লিখেছে, এটা এখন বন্ধ করা এখন সমীচীন হবে না বা যৌক্তিক হবে না।

মি. হালিম বলছেন, ”করোনা পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার পর থেকেই প্রতিষ্ঠান চালু রাখার বিধিবিধান মেনে যেভাবে তামাক কোম্পানিগুলো চলছিল, সেভাবেই এখনো চলবে বলেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

এর আগে মঙ্গলবার কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরণের তামাক পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন ও তামাকপাতা ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার এবং তামাক কোম্পানিগুলোকে দেয়া অনুমতিপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী যুগ্ম সচিব মোঃ খায়রুল আলম শেখ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাককে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সহায়ক হিসাবে চিহ্নিত করে এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার কথা বলেছে।

ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলোকে দেয়া উৎপাদন, সরবরাহ, ও বিপণন করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্র পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।

”জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে করোনাভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তামাক কোম্পানিকে প্রদত্ত অনুমতি প্রত্যাহারসহ সকল তামাক কোম্পানির উৎপাদন-সরবরাহ-বিপণন ও তামাকপাতা ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো,” চিঠিতে বলা হয়।

এই বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা যোগ দেন।

সেখানে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে রাতারাতি এই খাত বন্ধ করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না।

এর কারণ হিসাবে শিল্প সচিব মোঃ আবদুল হালিম বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

”তারা তামাক পাতা ক্রয় করা যাবে না বলে বলছে। কিন্তু তামাক পাতার সঙ্গে অসংখ্য চাষী জড়িত। তাহলে তো ওই চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দ্বিতীয়ত হলো, আমরা যদি বৈধভাবে উৎপাদন বিপণন বন্ধ করে দেই, তার মানে এই নয় যে ধূমপায়ীরা ধূমপান করবেন না। তখন কালোবাজারি হবে, সরকার রাজস্ব হারাবে।”

”আমরা তামাকের প্রসার বা প্রচারের পক্ষে নই। আস্তে আস্তে এটা কমিয়ে আনতে হবে। এটা একটা শিল্প, এখানে প্রচুর লোকজন কাজ করছে। সুতরাং এখান থেকে অন্যদিকে শিফট করতে গেলে, সময় নিয়ে নিয়ে, কৌশল ঠিক করে সেটা করতে হবে। এই শিল্প কোথায় যাবে, লোকগুলো কোথায় যাবে – সেটা একটা সময়ের ব্যাপার।”

”হঠাৎ করে একটা চিঠি দিয়ে এটা স্থগিত করা – আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটা যৌক্তিক হলো না।”

এর আগেও অনেকবার বাংলাদেশে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করার দাবি উঠেছিল। ধূমপানবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন এই দাবি জানায়।

তবে তামাকজাত পণ্যের প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাংলাদেশে এ জাতীয় পণ্য নিষিদ্ধ করা হয়নি।

বিড়ি, সিগারেটের বাইরে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে পানের সঙ্গে তামাকজাত জর্দা খাওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া, অনেকের মধ্যে আরেকটি তামাকজাত পণ্য গুলের ব্যবহার রয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তামাক শিল্প থেকে বাংলাদেশের সরকারের প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় হয়ে থাকে।

এইচডিআরসি ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ‘তামাক শিল্প এবং কর’ নিয়ে একটি গবেষণা করার সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে একটি সমীক্ষা করেছিল।

সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ২৮ শতাংশেরও বেশি সিগারেট খায় এবং কমপক্ষে ২১ শতাংশ পুরুষ বিড়ি খায়। পাশাপাশি, ২০০৭ সালের এক পরিসংখ্যান বলছে, ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোরদের কমপক্ষে দুই শতাংশ ধূমপান করে।

বর্তমানে বাংলাদেশে বাংলাদেশে সিগারেটের বাজার কমপক্ষে ২০,০০০ কোটি টাকার এবং তা ক্রমাগত বাড়ছে।

জাপান টোব্যাকো নামের একটি কোম্পানি এর আগে জানিয়েছিল যে বাংলাদেশ বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম সিগারেটের বাজার এবং এই বাজার প্রতি বছর দুই শতাংশে করে বাড়ছে।

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি এবং ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় ২০১৮ সালে এক জরিপ চালায়। সেই জরিপে ২০০৪ সালের তথ্যের তুলনা করে বলা হয় যে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের কারণে মৃত্যুর হার দ্বিগুণ হয়েছে।

তামাক ব্যবহারজনিত নানা অসুখে প্রতিবছর ১ লক্ষ ২৫ হাজারের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করেন বলে এতে বলা হয়।

বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়সের উপরে প্রাপ্তবয়স্কদের ৩৫ শতাংশের বেশি লোক তামাক ও তামাক জাতীয় পণ্য সেবন করে।