বিশ্ব ডাক দিবস : ঐতিহ্যের ডাকব্যবস্থার পুনরুদ্ধার চাই নবরূপে

খন রঞ্জন রায় »

আজ বিশ্ব ডাক দিবস। দিবসের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন ‘বিশ্ব ডাক দিবস’। বিশ্ব ডাক সংস্থা প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৭৪ সালের ৯ অক্টোবর। সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে। প্রথম দিকে ইউরোপের ২২টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার পর তথ্য আদান-প্রদান আর যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক বিপ্লব ঘটে। হাতের লেখা চিঠিপত্র, নথি, সার্কুলার, ভাব-বিনিময় ব্যবস্থা প্রচার ও প্রসারে যুগান্তকারী ঘটনার সূত্রপাত হয়। এর প্রায় শত বছর পর ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিও শহরে ইউনির্ভাসেল ডাক সংস্থার ১৬তম অধিবেশনের জাঁকজমক সম্মেলন হচ্ছিল। এই আন্তর্জাতিক ডাক সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য আনন্দ মোহন বিশ্ব ডাক দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তারিখ হিসাবে বেছে নেন বিশ্ব ডাক সংস্থা প্রতিষ্ঠার ৯ অক্টোবর দিনটিকেই। উপস্থিত বিশ্বডাক নেতৃবৃন্দ একমত পোষণ করেন এই প্রস্তাবে। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মানে ইউনিভার্সাল ডাক ইউনিয়নের সদস্য হয়ে প্রতিবছর অতি গুরুত্বের সাথে এই দিবস পালন করে আসছে।
নানা নথিপত্রের প্রমাণ বিচারে দেখা যায় ২৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে ডাক ব্যবহার করা হতো। এখন সেটা কুরিয়ার সার্ভিস, ঠিক এই আদলে। এরপর থেকে সময়ের প্রয়োজনে নানা বিবর্তনে ডাক তার সমৃদ্ধির শীর্ষ সোপানে পৌঁছে। পৃথিবীর প্রাচীনতম কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা এই উপমহাদেশে গড়ে ওঠে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে। তাঁদের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বোম্বাই মেল শিরোনামে মাদ্রাজ-কোলকাতায় অফিস খুলে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। লর্ড ক্লাইভের শাসনামলে ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ ‘পোস্টাল প্ল্যান’ নামে এক ব্যবস্থার সূত্রপাত করেন। তারিখ সন হিসাব কষে দেখা গেছে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ কলকাতায়, ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ এবং ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকে মুম্বাইয়ে এর সেবা সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন থেকে পোস্ট অফিস সেবা কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে ওঠার নিদর্শন পাওয়া যায়। শুরু হয় সেবার পরিধি বিস্তৃতিকরণ। সৃজন হয় ঐতিহাসিক রানার, ডাকপিয়ন থেকে পোস্ট মাস্টার জেনারেল পর্যন্ত পদ-পদবি।
বর্তমান বাংলাদেশে পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ডাক অধিদপ্তর নিয়ে দেশের বিস্তৃত অঞ্চলে ডাক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। প্রায় চল্লিশ হাজার চাকুরিজীবীর শ্রম-ঘাম, মেধা-মননে এদেশেই প্রায় ১৫০ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ ডাক ব্যবস্থা। ১৮৫৪ সালে সর্বভারতীয়ভাবে উপমহাদেশে ‘ডাকটিকেট’ ব্যবস্থা প্রচলনের পর ডাকের গতিপ্রকৃতি বদলে যায়। আলাদা স্বতন্ত্ররূপ লাভ করে। শুরু হয় রেলওয়ে ডাক। পোস্ট কার্ড ব্যবস্থা চালু হয় ১৮৭৯ সালে। বিমানে করে ডাক চালু হয় শুরু থেকেই ১৯১১ সালে। পরিবর্তন হয়ে পড়ে ডাকের রূপ-রহস্য। পায়রা-ডাক, ঘোড়ার ডাকের উপায়গুলো যে সময়সাপেক্ষ আর ঝামেলা ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তার অবসান হয়। বর্তমান আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় ডাক ব্যবস্থার উপর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও এই ব্যবস্থাকে সমসাময়িককরণ করা হচ্ছে। চালু হয়েছে ই-কমার্স পণ্য ডেলিভারি ব্যবস্থা। ভবন সংস্কারও গুরুত্বপূর্ণ। তাই নতুন নতুন পোস্ট অফিস ঘর তৈরি হচ্ছে। সম্প্রসারিত হচ্ছে ডাক অধিদপ্তরের অবকাঠামো। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের পাশাপাশি কার্যক্রম পরিচালনা করছে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক, ডাক জীবন বীমা, ডাকঘর সঞ্চয়পত্র, ডাক পার্সেল সার্ভিস, প্রাইজবন্ড, পোস্টাল অর্ডার, মানিঅর্ডার ইত্যাদি।
ডাক ব্যবস্থাকে দাপ্তরিক ভাষায় প্রধানত দুই ভাগ করা হয়। মূল সার্ভিস আর এজেন্সি সার্ভিস। দুই সার্ভিসেই এখন নিত্যনতুন প্রযুক্তিনির্ভর নানা ধরন ও মানের সেবাকর্ম চালু করা হচ্ছে। সাধারণ চিঠিপত্রের সাথে রেজিস্টার্ড, জিইপি, ইএমএস, পার্সেল, ভিপিপি, ভিপিএস ইত্যাদি চালু করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ডাক জাদুঘর। প্রদর্শন করা হচ্ছে তুলাদ- থেকে রাণী ভিক্টোরিয়ার সময়কালের উর্দি, বর্শা, লণ্ঠন, ডাকমাশুল ছাপানোর সরঞ্জাম আর সময়ে সময়ে ডাক কর্মচারীদের ব্যবহার্য পোশাক ও প্রতিকৃতি।
প্রাচীনতম বৈদিক গ্রন্থ অথর্ববেদে যেমন ডাক যোগাযোগ সর্ম্পকিত তথ্য পাওয়া যায়, তেমনি কালিদাসের কল্পচিত্র থেকে শুরু করে হাল আমলের গল্প-কবিতা, সাহিত্য, লোকগাথা জনপ্রিয় কিছু গানে ডাক একটি প্রভাবী ভূমিকা পালন করে। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সমৃদ্ধ ইতিহাসের ডাক ’সেবাই আদর্শ’ শ্লোগান নিয়ে ২০ জুলাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত প্রথম ডাকটিকেট প্রকাশ করে। স্বাধীন দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির দাপটের কাছে ডাকঘর ব্যবস্থা কিছুটা ম্লান হলেও হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ অবারিত। প্রায় ১০ হাজার ডাকঘর নিয়ে গ্রামীণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন কাক্সিক্ষত আর পরিবর্তিত যুগোপযোগী সেবা পৌঁছে দেওয়া হবে তখন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হবে ডাকসেবা। ভাঙ্গা চেয়ার টেবিল, কাঠের বাক্স নিয়ে বছরে যেখানে কেবল চিঠিই বিলি হয় ২০ কোটি, সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি সেবা নিশ্চিত করা গেলে এর পরিমাণ অনায়াসে দ্বিগুণ করা সম্ভব। মানুষের শিক্ষা দীক্ষা, ব্যক্তিত্ব রুচিবোধ বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে যেমন লেখাজোঁখা, চিঠিপত্র তেমনি প্রণয়ঘটিত ভাব ও ছন্দের নীরব সাক্ষী এই ডাক। ঐতিহ্যের ডাকব্যবস্থা। মোবাইল, ই-মেইল, ফেইসবুক, ইমু, ভাইভার, ওয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেঞ্জারের মত প্রযুক্তি নির্ভরশীল হই না কেন হাতের লেখার অনুভূতি, গুরুত্ব, তাৎপর্য অমলিন-অপরিসীম। মান্ধাতার আমলের বেহাল দশার ফিকে হয়ে যাওয়া নজুক ডাকব্যবস্থাকে চলমান আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে ডাক বিভাগের উন্নয়নকা- সচেতনভাবে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হোক এই প্রত্যাশা আমার একার নয়, সমগ্র দেশবাসীর।

লেখক : কলামিস্ট, গবেষক