বিশ্ব ক্যান্সার দিবস : বাংলাদেশে ক্যান্সার প্রতিরোধ ও প্রতিকারের রূপকল্প

সৈয়দ আকরাম হোসেন »

আজ ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্ব ক্যান্সার দিবস পালিত হচ্ছে। সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ক্যান্সারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। শরীরের যেকোনো অংশেই হতে পারে ক্যান্সার। মানবদেহ অসংখ্য কোষ দ্বারা গঠিত। এই কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে কিছুদিন পর মারা যায় এবং নতুন কোষ তাদের জায়গায় আসে। যখন এই কোষ বিভাজন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে, তখন টিউমারের উৎপত্তি হয়। কোষের জিনের পরিবর্তনের জন্য ক্যান্সার হয়ে থাকে। ক্যান্সার ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ ও শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কাউকে আক্রান্ত করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে অধিকাংশ ক্যান্সার রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।
আমাদের দেশে ক্যান্সারের প্রতিরোধ, নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি, যদিও বিগত কয়েক দশকে ক্যান্সার চিকিৎসার প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছে। সূচনায় ক্যান্সার নির্ণয় না হওয়ায় চিকিৎসা বিলম্বিত হয়। কিন্তু যখন তারা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের কাছে যায়, তখন সুচিকিৎসার জন্য আর তাদের পর্যাপ্ত সময় থাকে না। কারণ, ক্যান্সার খুব দ্রুত শরীরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (আইএআরসি) ২০১৮-এর প্রাক্কলিত তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ নতুন ক্যান্সাররোগী রয়েছে। যার মধ্যে ৮৩ হাজার পুরুষ ও ৬৭ হাজার নারী। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত বছর ক্যান্সারে প্রায় এক লাখ রোগী মারা গেছে। নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার, জরায়ুমুখের ক্যান্সার, মুখ ও গলার ক্যান্সার বেশি। অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুস, খাদ্যনালি, মুখ-গলা ও কোলন ক্যান্সার বেশি।
ক্যান্সার হওয়ার নিশ্চিত কারণ এখনো নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি, তবে সম্ভাব্য কিছু কারণ জানা গেছে। যেমন, তামাক সেবন কমপক্ষে ৩০ ভাগ ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তামাক সেবনের কারণে ফুসফুস, স্বরতন্ত্র, মুখ, খাদ্যনালি, মূত্রথলি, কিডনি ও জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ৩৫ ভাগ ক্যান্সারের জন্য দায়ী। যেমন ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা পাকানো ফলফলাদি, রং মেশানো খাবার, ইউরিয়া দিয়ে সাদা করা মুড়ি ইত্যাদি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। মদ্যপানও ক্যান্সারের অন্যতম একটি কারণ।
ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করার জন্য নানাবিধ চিকিৎসা-প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। যেমন: শল্যচিকিৎসা, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, হরমোনাল থেরাপি, ইমিউনথেরাপি ইত্যাদি। ক্যান্সার চিকিৎসার ২০ ভাগ শল্যচিকিৎসা, ৬০-৭০ ভাগ রেডিওথেরাপি এবং ২৫-৩০ ভাগ কেমোথেরাপির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় ক্যান্সার চিকিৎসার স্থাপনা অপ্রতুল। ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা হাসপাতাল, ১২টি মেডিকেল কলেজে ক্যান্সার বিভাগ এবং বেসরকারি খাতে সাতটি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বমানের অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা রয়েছে স্কয়ার, ইউনাইটেড ও অ্যাপোলো হাসপাতালে। কিন্তু এসব হাসপাতালের চিকিৎসার ব্যয়ভার সবাই বহন করতে পারে না। ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার জন্য আরও অনেক হাসপাতাল, বিশেষ করে ঢাকার বাইরে হাসপাতাল স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া আমাদের দেশে ক্যান্সার নিয়ে খুবই সীমিত পর্যায়ে গবেষণা হয়। এটা বাড়ানো দরকার।
বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সার প্রতিরোধ ও ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ সনদে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। তাই ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে যথাযথ পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল গ্রহণ করতে হবে। যেমন, দেশে ক্যান্সার রোগীর নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করা, স্বাস্থ্য বিমার মাধ্যমে ক্যান্সার রোগীদের সহায়তা প্রদান, ক্যান্সার বিষয়ে গবেষণা বাড়ানো, ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ তহবিল গঠন, সাশ্রয়ী মূল্যে ক্যান্সারের ওষুধ সরবরাহ ইত্যাদি।
যেহেতু তামাক ৩০ ভাগ ক্যান্সারের জন্য দায়ী, তাই তামাক সেবন প্রতিরোধের ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তামাক থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়, তামাকের ব্যবহারজনিত রোগের কারণে হাসপাতালের ব্যয় তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, স্কুলের পাঠ্যক্রমে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তামাক বিরোধী আইন কার্যকর করতে হবে এবং তামাকের মূল্য বাড়াতে হবে।
অত্যন্ত আশঙ্কার কথা যে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের প্রতিটি পরিবারের কেউ না-কেউ ক্যান্সারে ভুগবে। কিন্তু তা প্রতিরোধে আমরা কি প্রস্তুত? আমাদের কি পর্যাপ্ত হাসপাতাল, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট আছে? সংশ্লিষ্ট সবাইকে একটি রূপকল্প প্রণয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিপর্যয় মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে।

লেখক : সিনিয়র কনসালটেন্ট ও
বিভাগীয় প্রধান, নিউরোলজি বিভাগ, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড