বিপম চাকমা

সহেলী আদাম :

 

আতিক সাহেব প্রস্তাব দিলেন চাইলে হেডম্যান নিজেও কিনে নিতে পারে। তাকে তিনি একেবারে পানির দরে দিয়ে দিবেন। লাখ দশেক হলেই হবে। আতিক সাহেব ভাবলেন, এ কৌশলে যদি কাজ হয় তাতে টাকা যা পান সেটাই লাভ।

সব কৌশলে ব্যর্থ হলে আতিক সাহেব শেষ অস্ত্রটা প্রয়োগ করলেন। বললেন, ডিসি সাহেব তার পরিচিত-ঘনিষ্ঠ এবং এক কালের অধীনস্থ জুনিয়র অফিসার। চাইলে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশ এনে জায়গার দখল নিতে পারেন। কিন্তু তিনি আপোষে বিশ্বাসী। অতদূর যেতে চান না। কথাটা বলে বুঝতে পারলেন যে, খুব বেশি জোর দিয়ে বলতে পারেননি। কারণ কথাটা অর্ধসত্য। ডিসি তার পরিচিত এবং জুনিয়র কিন্তু আমলা চরিত্র বুঝেন বলেই তিনি জানেন, একটা প্রাপ্তিহীন স্পর্শকাতর বিষয়ে হাত দিয়ে কোনো ডিসিই চাইবে না নিজের ভবিষ্যতকে ঝাপসা করে তুলতে। তার উপরে তিনি অবসরপ্রাপ্ত, ফেটে গিয়ে উড়তে থাকা তুলোর মতোই একেবারে গুরুত্বহীন। কথাটা শুধু প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবে ভয় দেখানোর জন্য বলা।

লোকটা তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। আতিক সাহেব বিরক্তিবোধ করলেন। জীবনে এত ঠা-া লোক তিনি আর দেখেননি। জীবনে কোনো কিছুতে প্রতিক্রিয়া দেখাতেই যেন সে শেখেনি। কেবল হাসতে জানে। তার মনে হলো লোকটা তাকে নিয়ে খেলছে। আর তিনি অন্ধকারে এটা-ওটা বলে শুধুু চিৎকার করে যাচ্ছেন। দিক খুঁজে পাচ্ছেন না। বুঝতে পারলেন, নিজের ভেতরে কিভাবে অসহায়ত্বের পোকাগুলো কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ মুহুর্তে পাশে একজন সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন।

লোকটা বললো, ‘স্যার আপনার একটা সন্তানের আশ্রয় করে দিতে আপনি আমার এক শ সন্তানের আশ্রয় কেড়ে নিতে পারবেন?’

আতিক সাহেব থমকে গেলেন। কি বলবেন আর ভেবে পেলেন না।

শেষে মরিয়া হয়ে জানালেন, জমিটা এক পলক দেখার ইচ্ছার কথা।

পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ওঠানামা করতে করতে আতিক সাহেববুঝতে পারলেন এই অনভ্যস্থ আর অচেনা পরিবেশে তিনি কতটুকু আগন্তুক। আর তিনিই কিনা দাবি করতে এসেছেন এই জমিটুকু তার। স্রেফ একটা কাগজের জোরে। যে জমি কখনও চোখে দেখেননি।

অর্ধেক পথ হেডম্যানের মোটর সাইকেলের পিছনে এসে বাকিটুকু আসতেই তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন। একটা পাহাড়ের চুড়োয় উঠে হেডম্যান দেখিয়ে দিলেন নিচের দিকে একটা পাহাড়ি ছড়ার কূল বেয়ে গড়ে ওঠা ছোট্ট গ্রাম। ঘর হয়তো ত্রিশটার বেশি হবে না। তিনি ম্যাপশিটে দেখা সংকেত চিহ্নগুলোর কথা মনে করার চেষ্টা করলেন। সীমানায় এমন  কথাই লেখা আছে। পূর্বে পাহাড়ি ছড়া, উত্তর-দক্ষিণ এবং পশ্চিম তিনদিকেই পাহাড়।

আতিক সাহেব গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলতে চাইলেন। গ্রামের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে তাদের অভ্যর্থনা জানালো। তারা গেলেন সবচেয়ে বৃদ্ধ লোকটির বাড়িতে। এখানেই লোকটির জন্ম। সে তার বয়স জানে না। আতিক সাহেব অনুমান করলেন ষাট কি সত্তর হতে পারে। খেটে খাওয়া মানুষ। অল্প বয়সেই চেহারার লাবণ্য উবে যায়। তবে ভিতরে শক্ত থাকে।

তাদের বসার জন্য একটা নড়বড়ে চেয়ার বের করে দেয়া হলো। আর আনা হচ্ছে না দেখে আতিক সাহেব অনুমান করলেন বাড়িতে এই একটিই চেয়ার। আশঙ্কা করলেন বসলে না আবার এটি ভেঙে পড়ে। চেয়ারে না বসে তিনি ছোট্ট উঠোনের একপাশে ঘন সবুজ গাছের তলে বাঁশ দিয়ে বানানো একটা মাচাঙের মত আসনে বসলেন। পরিচ্ছন্ন আছে, বেশ ছায়াও দেখা যাচ্ছে।

হঠাৎ গায়ের উপর কি যেন এসে পড়লে তিনি একটু আঁতকে উঠলেন। কেউ কি ঢিল ছুড়লো? তাকিয়ে দেখলেন, আরও কিছু কাঁচা-পাকা কামরাঙ্গার সাথে কিছুক্ষণ আগে তাকে ছুঁয়ে দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়া একটা কামরাঙ্গা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বৃদ্ধ বললো, গাছের কামরাঙ্গা, টিয়া পাখি এসে নষ্ট করে। তিনি উপরের দিকে তাকালেন। সবুজ দেহে লালের সমবায়ে একটা চন্দনা নুয়ে পড়া ডালের সাথে ফলের থোকা ধরে ঝুলছে। চিড়িয়াখানা আর কাঁটাবনের খাঁচাগুলোতে কত চন্দনা দেখেছেন, এত সুন্দর তো কখনও মনে হয়নি। তিনি মনের মধ্যে ভালোলাগার বুদবুদ টের পেলেন। বৃদ্ধ লোকটি হেই হেই শব্দ করে একটা ঝুলন্ত রশি ধরে বার কয়েক টান দিলো। টান পড়তেই গাছের উপরে কোথাও ঝোলানো টিন বেজে উঠলো। সাথে সাথে একঝাঁক টিয়া ক্যাঁক ক্যাঁক করতে করতে উড়ে চলে গেল। কি কাজে এসেছেন সেকথা ভুলে তিনি হয়তো আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন।

-‘না না তাড়াবেন না, ওদেরও খেতে দিন, ওদেরও তো বাঁচতে হবে।’ তিনি যেন পক্ষীপ্রেমিক হয়ে উঠলেন।

বৃদ্ধকে এসব স্পর্শ করে না। ফল ফেলে উঠোন নোংরা করে এই তার অভিযোগ।

ডাবের পানিতে তারা আপ্যায়িত হলেন। প্রতিটা বাড়ির সাথে কোনো না কোনো ফলের গাছ। আম, কাঁঠাল আর নারিকেলই বেশি। কিছু নারিকেল গাছের উচ্চতা আর অন্য ফল গাছের কা-ের সাইজ দেখে বুঝা যায়  কোনোটিরই বয়স অর্ধশত বছরের কম নয়। বৃদ্ধ লোকটি জানালো এর অধিকাংশই তার বাপ-দাদাদের লাগানো। এসব দেখে গ্রামটির প্রাচীনত্বের বিষয়ে আতিক সাহেবের মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না। তিনি বুঝলেন সরকারি নথিপত্র আর বাস্তবচিত্রের মধ্যে কত তফাৎ।

ঢাকায় ফিরেই আতিক সাহেব গিন্নির প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন।

কি বেচতে পারলে?

আতিক সাহেব একটু হেঁয়ালির সুরে উত্তর দিলেন, তোমার জমি আমি বেচবো কিভাবে? জমি তো তোমার নামে।

সহেলী বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসলেন যেন বিষয়টা আজ তিনি নতুন জানলেন।

গিন্নি ভাবলেন, একটা ব্যবস্থা বুঝি হয়েছে। জমিটা যেহেতু তার নামে। সুতরাং বিক্রির কাজ সম্পন্ন করতে তাকে লাগবে।

রেজিস্ট্রি প্রদানের কাজ শেষ করে হোটেল কক্ষে ফিরে আতিক সাহেব স্ত্রীকে উদ্দেশ করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত টাকাগুলো তোমার কপালে জুটলো না।’

স্বামীর কথা শুনে সহেলী বেগম দার্শনিক হয়ে গেলেন। বললেন, সব লোকের অর্থভাগ্য ভালো হয় না। আমারও কখনও ভালো ছিল না।

আতিক সাহেব নিজের ফোন খুলে স্ত্রীকে একটা ছবি দেখালেন। তাতে একটা সাইনবোর্ড, বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে- গ্রামের নাম : সহেলী আদাম।

সহেলী বেগম জানতে চাইলেন, ‘আদাম’ মানে কি?

আতিক সাহেব জবাব দিলেন, ‘আদাম’ মানে গ্রাম।  (শেষাংশ)