বিধাতার ক্ষমা, সন্তুষ্টি ও প্রতিদান যাঁদের জন্য

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »

আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু’র জন্যই সমস্ত স্তুতি, বন্দনা, প্রশংসা ও গুণগান, যিনি সমস্ত ত্রুটিÑবিচ্যুতি থেকে মুক্ত, পবিত্র, অমুখাপেক্ষী ও অভাবহীন। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করি, অপবিত্র অবস্থায় নামায পড়াও যিনি অনুমোদন করেন না। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি আমাদেরকে ‘আশরাফুল’ মাখলুকাত’র মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। আমাদের দিশারী, মুক্তির কা-ারী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা এবং তাঁর রাসূল, যাঁর প্রিয় সহচরবৃন্দকেও মহান আল্লাহ্ উম্মতের শ্রেষ্ঠ মর্যাদা প্রদান করেছেন।
আল্লাহ্ তাআলা পৃথিবীর সকল উম্মতের মধ্যে উত্তম ও শ্রেষ্ঠতম বানিয়েছেন আখেরী নবীর উম্মতকেই। এ শ্রেষ্ঠত্ব নিঃসন্দেহে নবীজির কারণে। তাঁর সম্পর্কের কারণে যদি উম্মতের মর্যাদা স্বীকৃত হয়, তবে তাঁর উম্মতের শীর্ষ সম্মানের অধিকারী হবেন তাঁর সাহাবীগণ। আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুরআনে আমাদের নবীর প্রিয় সহচরবৃন্দের মহিমার বিবরণ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘(হযরত) মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র রাসুল। আর তাঁর সহচরগণ হলেন খোদাদ্রোহীদের প্রতি কঠোর, পরস্পরের প্রতি বিন¤্র চিত্ত। আপনি তাঁদেরকে দেখবেন রুকু সাজদায় আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি অন্বেষায় রত। তাঁদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাঁদের চেহারাগুলোতে সিজদার চিহ্ন (বা আলামত) প্রতিভাত হয়। সেটা হল তাওরাতে বিদ্যমান তাঁদের দৃষ্টান্ত। আর ইন্জীলÑএ তাঁদের উদাহরণ হল কৃষিক্ষেত্রের মত। যা, তার চারাগাছ নির্গত করে, এরপর এতে পুষ্টি যোগায়। অতঃপর ক্রমে তা শক্ত হয় এবং এক পর্যায়ে নিজ কা-ের ওপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়ে যায়। যা বিমোহিত করে দেয় খোদ কিষাণদেরও। যাতে তাঁদের কারণে কাফিরদেরও অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি হয়। আর আল্লাহ্ তাদের মধ্যে যাঁরা ঈমান আনে ও নেক আমল করে তাঁদের সাথে মাগফিরাত ও মহা প্রতিদানের ওয়াদা করেছেন।’ (সুরা ফাৎহ্ : আয়াত-২৯)
আয়াতে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যসমূহ হল সাহাবায়ে কেরামের। আয়াতের প্রারম্ভ হল আল্লাহ্র রাসূল’র উল্লেখ পূর্বক, কেননা পরবর্তীতে যে গুণ বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা রয়েছে, তা আসহাবে রাসূল’র। রাসূলুল্লাহ্র সাহাবী বলেই তাঁদের সমূহ মর্যাদার অধিকারী। প্রথমে বলা হয় যে, মুহাম্মদ (দ.) আল্লাহ্র রাসূল। রাসূল’র সম্পর্ক আল্লাহ্র সাথে, আর সাহাবার সম্পর্ক রাসূল’র সাথে। ‘নিসবৎ’ বা সম্পর্কের ভিত্তিতেই মর্যাদার নির্ণয় হয়। সাহাবী শুধু নবীর সঙ্গ বা সাহচর্যই লাভ করেননি; বরং তাঁদের সামগ্রিক চিন্তা-ভাবনা ও কার্যক্রম সবকিছু আল্লাহ্র রাসূলের প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণে পরিশীলিত হয়েছে। নবীজির নিজ হাতে গড়া সোনার মানুষ এঁরা। আল্লাহ্ তাআলা তাঁদের এ প্রশিক্ষণ ও নবীর সাহচর্যের অতুলনীয় মর্যাদা দান করেছেন।
স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলার ভাষায় পবিত্র কুরআনেই বর্ণিত হয়েছে তাঁদের এ হেন মর্যাদার কথা। রাসূল এবং তাঁর সঙ্গে যাঁরা আছেন, তাঁদের সমন্বিত উদ্ভব ও উৎকর্ষের এক মনোজ্ঞ চিত্রকল্প এ আয়াতে অঙ্কিত হয়েছে। এক চারা, তার উত্থান, কা- শক্ত হওয়া, ঋজু হয়ে দাঁড়ানো, বিকশিত হওয়াÑএ উদাহরণ রাসূলুল্লাহ্ ও তাঁর সাহাবীগণের। প্রাথমিক বিকাশ থেকে ইসলাম’র বিকাশমান ক্রমধারার জীবন্ত উদাহরণ। প্রাথমিক অবস্থায় নবী করিম (দ.) একাই দাঁড়ান। তাঁর আহ্বান পেয়ে প্রথম যুক্ত হন সিদ্দীকে আকবর। তারপর এক এক করে তাঁর চারপশে জড়ো হতে থাকে সাহাবায়ে কেরামের দল। ইসলামের কচি কিশলয় ক্রমে পুষ্ট হতে থাকে। হযরত কাতাদাহ্ (রা.) বলেন, সায়্যিদে আলম (দ.)’র সাহাবায়ে কেরাম’র উদাহরণ ইনজীল কিতাবে এরূপ লিপিবদ্ধ হয় যে, একটি সম্প্রদায়ের ফসল ক্ষেতের মত উদ্ভব ঘটবে। তাঁরা পুণ্য কাজের আদেশ দেবেন, পাপ কাজে বাধা প্রদান করবেন। এ ক্ষেত হলেন হুযূর (দ.) এবং এ বৃক্ষের শাখাÑপ্রশাখা হলেন তাঁর সাহাবা আর সকল ঈমানদার উম্মত। (খাযাÑইনুল ইরফান)
সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.)র ওয়াফাত পরবর্তী ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হিসাবে নিয়োজিত হন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাদ্বি.)। দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে তিনি সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.) কে সর্বাত্মক আনুগত্য করেন এবং তাঁকে সর্বতো সহযোগিতা করেন। তাঁর শাসনামলে ইসলামী সা¤্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি পায়। খোলাফায়ে রাশেদীন’র শাসনামল ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণ যুগ হিসাবে চিহ্নিত। তাঁরা ইসলামের শ্রীবৃদ্ধি, মুসলিম উম্মাহর সেবাদানের জন্য নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। হযরত ওমর (রাদ্বি.) যেদিন খলীফা হিসাবে প্রথম খুৎবা দিতে মিম্বরে আরোহন করেন, তখন তাঁর জামা মুবারকে বারোটি তালি লাগানো ছিল। কারণ, সম্পদ আহরণে তাঁদের কোন আগ্রহই ছিল না। তাঁর খাবারে ব্যঞ্জন ছিল শুধু যায়তুনের তৈল। রাষ্ট্রের কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো বলে বায়তুল মাল হতে পুরো পরিবারের ভরণপোষণের জন্য মাত্র দু’দিরহাম মাসোহারা গ্রহণ করতেন। আটার বোঝা নিজে কাঁধে বহন করে গরীব প্রজার ঘরে পৌঁছে দিতেন স্বয়ং খলীফা। তিনি সেই প্রতাপশালী খলীফা যাঁর বদৌলতে আল্লাহ্ দ্বীনে ইসলাম’র মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।
উক্ত আয়াতে যদিও সকল সাহাবীর গুণ বৈশিষ্ট্য বর্ণিত, তবে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্য প্রধান চার খলীফার মধ্যে বিশেষভাবে প্রতিফলিত। তাঁর অর্থ এ নয় যে, কোন গুণ তাদের কারো একজনের নেই। বরং বর্ণিত সকল ফযীলত সকলের মাঝেই বিদ্যমান, তবে এ মহান খলীফা চতুষ্টয়ের মাঝে এ গুলো প্রধানত ও সর্বাধিক হারে পরিস্ফুটিত। তাছাড়া ইসলামের ইতিহাসে ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’ বলতেও এ চারজনকেই বুঝানো হয়। বাযখার বর্ণিত হযরত জাবের (রাদ্বি.) বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলে আকরাম (দ.) ইরশাদ করেন, ‘সমগ্র মুসলিম জাহান হতে আল্লাহ্ তাআলা সর্বাগ্রে পছন্দ করে নিয়েছেন আমার সাহাবীগণকে। এরপর আমার সাহাবীগণের মধ্য হতে চারজনকে আমার জন্য বিশেষভাবে বাছাই করে নিয়েছেন। এরা হলেন, আবু বকর, ওমর, ওসমান এবং আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)। এ বর্ণনা পূর্বোক্ত তথ্যকে সহায়তা যোগায়। আয়াতের চার বৈশিষ্ট্য ইঙ্গিত করে চার খলীফার দিকে। যেমন, যারা তাঁর সাহচর্যে থাকেন-এ বৈশিষ্ট্য অধিকতর ক্রিয়াশীল হযরত সিদ্দীকে আবু বকর (রাদ্বি.)র মধ্যে, কাফির মোকাবেলায় কঠোর-এটা নির্দেশ করছে ফারুকে আ’যম (রাদ্বি.)র প্রতি। পরস্পরে দয়ার্দ্রচিত্ত এ বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছে হযরত ওসমান (রাদ্বি.)র মাঝে। রুকু-সাজদার মাধ্যমে ইবাদত গুজার হওয়ার বৈশিষ্ট্য দ্বারা মাওলা আলী (রাদ্বি.)র রিয়াযত বুঝানো হয়েছে।
আল্লাহ্ তাআলা তাঁদের জন্য ক্ষমা এবং মহান প্রতিদানের ওয়াদা দিয়েছেন। তিনি তাঁদের সৌভাগ্যের বর্ণনা দিতে এটাও ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহ্র অনুগ্রহে সন্তুষ্ট। তাঁদের জন্য আল্লাহ্র এমন সুস্পষ্ট ঘোষণা পবিত্র কুরআনে থাকা সত্ত্বেও যারা তাঁদের অবমাননা করে তাঁরা প্রকারান্তরে আল্লাহর বাণীকেই অবজ্ঞা করল, মাআÑযাল্লা-হ্।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।