বিদায় অবিস্মরণীয় ২০২০, স্বাগত ২০২১

রায়হান আহমেদ তপাদার »

টুয়েন্টি টুয়েন্টি বিস্ময়কর এবং হতবাক করা এক বছর। এমনকি টুয়েন্টি টুয়েন্টি ছিল এক বিধ্বংসী বছর। চীনে ছড়িয়ে পড়েছিল এক প্রাণঘাতী ভাইরাস, কিন্তু তখনো পর্যন্ত এর সম্পর্কে জানা গেছে খুব কমই। যথাযথ সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে মানুষ বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রতিদিনের নিত্যব্যবহার্য জিনিস। বিশ্বের মানুষকে সম্মোহিত করে রেখেছিল সুপারমুন। জ্যোতির্বিদ্যার দিক থেকে এটি ছিল বছরের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তুরস্কের এডির্নে শহরে ষোড়শ শতকের সেলিমিয়ে মসজিদের মিনারের কাছ থেকে এই ছবি তোলা হয়েছিল। করোনাভাইরাসের নিষেধাজ্ঞার কারণে টুয়েন্টি টুয়েন্টি বছরে আমরা অনেকেই দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি অনলাইনে। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ, কাজ, শপিং এগুলো তো আছেই। তার সঙ্গে ক্লাশও চলেছে অনলাইনে। হংকং এর এই শিক্ষক যেমন তার অনলাইন ক্লাসের জন্য পাঠ রেকর্ড করছেন। সামাজিক দূরত্বের জন্য নেয়া নানা পদক্ষেপের কারণে মানুষকে তাদের কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য বহু ধরণের সৃষ্টিশীল পথ খুঁজে নিতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক রোমান ক্যাথলিক পাদ্রী একটি ওয়াটার পিস্তল দিয়ে তার গির্জায় আসা মানুষের ওপর পবিত্র জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এক আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকে পুলিশ গ্রেফতারের পর যেভাবে মেরে ফেলেছিল সে ঘটনা বিশ্ব জুড়ে বর্ণবাদ এবং পুলিশি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলনের সূচনা করে। যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে যেসব বিক্ষোভ হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টোর এই বিক্ষোভ ছিল তার শুরুর দিকের একটি।
করোনা সংক্রমণের প্রথম দফা লকডাউনের পর বার্সেলোনার গ্রান্ড থিয়েটার যখন বেশ সাড়ম্বরে খোলা হয়েছিল, তখন সেখানে নার্সারি থেকে আনা দুই হাজারের বেশি চারাগাছের সামনে প্রথম অনুষ্ঠানটি করা হয়। এই কঠিন দুঃসময়েও শিল্পের গুরুত্ব যে কত বেশি, তা ফুটিয়ে তোলাই ছিল এর লক্ষ্য। কেনিয়ায় যখন পঙ্গপাল এসে এক নারীর ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করছে, তখন তা অসহায়ভাবে দেখছেন তিনি। ইরান, পাকিস্তান এবং ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসল ধ্বংস করার পর এই পঙ্গপাল পূর্ব আফ্রিকার দিকে অগ্রসর হয়। লেবাননের বৈরুত বন্দর ধ্বংস করে দিয়েছিল যে বিস্ফোরণ, পরমাণু বোমার কথা বাদ দিলে তা ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী এক বিস্ফোরণ। এ ঘটনায় প্রায় দুশো মানুষ নিহত হয়। আহত হয় আরও হাজার হাজার মানুষ। পিয়ানো বাদক রেমন্ড এসিয়ান এই বিস্ফোরণের ধাক্কায় আহত হন এবং গৃহহীন হয়ে পড়েন।
এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্রাজিলের আমাজন বনাঞ্চল। এটি পরিবেশবাদী এবং সংরক্ষণবাদীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করে। জাগুয়ারটি পানটানাল অঞ্চলের দাবানল থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু তার পায়ের থাবা পুড়ে যায়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন উঠানামা করছিল, তখন বিভিন্ন দেশের সরকারকে বার বার লকডাউনের নিয়মÑকানুন কঠোর বা শিথিল করতে হচ্ছিল। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলছিল, করোনাভাইরাসের কারণে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ইটালির রাজধানী রোমের রেস্টুরেন্ট তাদের ব্যবসা যে পথে বসতে চলেছে তা বোঝাতে কংকালের সামনে খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে তা প্রতীকীভাবে তুলে ধরে।
থাইল্যান্ডের মিত্রি চিটিনুয়ানদা ছিলেন রাজপরিবারের ঘোরতর সমর্থক। কিন্তু এবছর থাইল্যান্ডে গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং রাজতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করার দাবিতে যে অভূতপূর্ব বিক্ষোভ শুরু হয়, সেটির পর তিনি পক্ষ বদলান। তিন আঙ্গুলের আকারে মিত্রি তার চুল কেটেছেন হাঙ্গার গেমস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। থাইল্যান্ড জুড়ে আরও অনেক বিক্ষোভকারী তাদের হেয়ারস্টাইলে এই প্রতীক ব্যবহার করেছেন। করোনাভাইরাসের দাপটে পৃথিবী তছনছ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, কিন্তু তার মধ্যেও মহাকাশ নিয়ে প্রতিযোগিতা থেমে নেই।
চীন হচ্ছে দ্বিতীয় কোন দেশ, যারা চাঁদের মাটিতে তাদের পতাকা পুঁততে পেরেছে। একই সঙ্গে গত ৪৪ বছরের মধ্যে এই প্রথম চাঁদের মাটি পৃথিবীতে সফলভাবে বহন করে আনলো তাদের চ্যাঙই-৫ নভোযান।করোনাভাইরাস মহামারি এবং তার ফলে বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক ধসের কারণে ২০২০ সালকে মানুষ যেমন ভবিষ্যতে বিপর্যয়ের একটা বছর হিসাবে মনে রাখবে, তেমনি ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে এমন আরও ভয়ঙ্কর ও বিপর্যয়ের বছর মানুষ অতীতে প্রত্যক্ষ করেছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের পরিসংখ্যান বলছে জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংকলিত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ছে ৭ কোটি ৪৫ লক্ষ মানুষ এবং মারা গেছে ১৬ লাখ। কিন্ত ইতিহাসে এর চেয়েও ভয়ঙ্কর মহামারির ঘটনা অতীতে ঘটেছে। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব অভাবনীয় এক সংকটে পড়েছে। বিশ্বের অর্থনীতি এই বছরে অন্তত তিন শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যেহেতু কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতির অবনতি হচ্ছে।
কিন্তু উনিশশো ত্রিশÑএর দশকের মহামন্দার পরে বিশ্ব সবচেয়ে বড় মন্দার মুখোমুখি হয়েছে। করোনা মহামারি যেভাবে বিশ্বকে সংকটে ফেলেছে, তা অভাবনীয়। এই দীর্ঘমেয়াদি প্রাদুর্ভাব বিশ্বের সরকারগুলো এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সংকট নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতাও পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ বলছেন, এই সংকটের ফলে সামনের দুই বছর ধরে বিশ্বের প্রবৃদ্ধি ৯ ট্রিলিয়ন ডলার কমে যেতে পারে। আইএমএফ-এর সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর দ্রুত পদক্ষেপের যদিও প্রশংসা করা হয়েছে, কিন্তু সেখানে এটিও বলা হয়েছে যে, কোন দেশই অর্থনীতির অবনতি এড়াতে পারবে না। সংস্থাটি আশা প্রকাশ করে বলেছে যে, মহামারির প্রকোপ যদি টুয়েন্টি টুয়েন্টি সালের দ্বিতীয় অর্ধেকে হ্রাস পায় তাহলে আগামী বছর বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধি ৫.৮ শতাংশ হতে পারে। বর্তমানের ‘গ্রেট লকডাউন’ নীতিনির্ধারকদের জন্য ‘কঠোর বাস্তবতা’ তুলে ধরেছে, যারা এই ভাইরাসের আঘাতের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারেননি। দুই হাজার একুশ সাল নাগাদ এসব ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ভাইরাস-পূর্ব সময়ে প্রবৃদ্ধির হার যেরকম ছিল,এই সময়ে হার তার চেয়ে কমই থেকে যাবে। সেই সঙ্গে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাও অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে যাবে। এছাড়া করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বে বিশ কোটি মানুষ চাকরি হারাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। আইএমএফ সতর্ক করে দিয়ে বলছে, উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধিও অন্তত দুই হাজার বাইশ সালের আগে আর ভাইরাস-পূর্ব অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরে যাবে না।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এ বছর ৫.৯ শতাংশ সংকুচিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ১৯৪৬ সালের পরে সবচেয়ে বেশি পতন। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হারও বেড়ে ১০.৪ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুই হাজার একুশ সাল নাগাদ সেটি আংশিক পুনরুদ্ধার হতে পারে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪.৭ শতাংশ। চীনের অর্থনীতি এ বছর ১.২ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা উনিশশো ছিয়াত্তর সালের পর সবচেয়ে শ্লথগতির। এবং উনিশশো একানব্বই সালের পর প্রথমবারের মতো আবার মন্দার মুখে পড়তে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে যদি আরও সময় লাগে এবং দুই হাজার একুশ সাল নাগাদ যদি আরেক দফা প্রকোপ দেখা দেয়, তাহলে হয়তো বিশ্ব প্রবৃদ্ধি থেকে আরও আট শতাংশ হারিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে ঋণগ্রস্ত অর্থনীতির দেশগুলোর অবস্থা আরও খারাপ দিকে যাবে। বিনিয়োগকারীরা হয়তো এরকম বেশ কিছু দেশকে আর ঋণ দিতে চাইবে না, ফলে তাদের ঋণ গ্রহণের ব্যয়ভার আরও বাড়িয়ে তুলবে। এমনকি ঋণ গ্রহণের ব্যয়ভার বেড়ে যাওয়া অথবা সেরকম আশঙ্কার ফলেও অনেক দেশ তাদের আয় সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে। যদিও লকডাউন অর্থনৈতিক কর্মকা-ে বাধা সৃষ্টি করবে। তবে আইএমএফ বলছে যে কোয়ারেন্টিন এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাইরাসটির বিস্তার শ্লথ করতে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সময় দিতে, বর্তমানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে যতটা সম্ভব আগে এবং আরও ভালোভাবে পুনরায় অর্থনৈতিক কর্মকা- শুরু করা যায়। সেই প্রত্যাশা বিশ্ববাসীর। যাইহোক,ভালো-মন্দ মিলিয়ে শেষ হতে চলেছে আরো একটি বছর। অনেক ঘটনা, আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনায় মুখর ছিল এই বছর। পরিশেষে বলবো,বিদায় ২০২০, স্বাগত ২০২১।এবং পেরিয়ে আসা বছরে এমন অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে যার রেশ আমাদের মনে থেকে যাবে বহু দিন।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স