বায়ুদূষণ, আসন্ন শীত ও করোনা সংক্রমণ

সাধন সরকার »

করোনা মহামারিকালে লকডাউনের সময় বায়ুদূষণের কবল থেকে কিছুটা স্বস্তি মিললেও আবার স্বরূপে ফিরছে বায়ুদূষণের অস্বস্তি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রায় সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে শান্ত প্রকৃতি-পরিবেশের ওপর আবারও সেই বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে! সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়া ও হেলথ ইফেক্ট ইনস্টিটিউটের ‘বিশ^ বায়ু পরিস্থিতি-২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ২০১৯ সালে দেশে বায়ুদূষণজনিত রোগে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৮ সালেও ১ লাখ ৭০ হাজার ৪০০ জনের মৃত্যু হয় বায়ুদূষণে। এককথায় ২০১২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বায়ুদূষণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৯ সালে বায়ুদূষণে বিশে^ সাড়ে ৬৭ লাখ মানুষ অকালে মারা গেছে। বিশ^জুড়ে প্রতিবছর শিশুমৃত্যুর ২০ শতাংশ হয় বায়ুদূষণজনিত নানা রোগে ভুগে। বিশ^জুড়ে মানুষের মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে চতুর্থ শীর্ষ হলো বায়ুদূষণ। প্রতিবেদনে বিশে^র সবচেয়ে দূষিত বায়ুর অঞ্চল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণে দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশে।
বিশে^র বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ তথ্যমতে, ঢাকা প্রায় প্রতিদিনই শীর্ষ বায়ুদূষণকারী শহরগুলোর প্রথম পাঁচটি শহরের তালিকার মধ্যে অবস্থান করে চলেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণের দিক দিয়ে বিশে^র অন্যতম শীর্ষ শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই! বায়ুদূষণের কারণে মানবশরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধছে। মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে। দূষণের যন্ত্রণা থেকেই নগরবাসী যেন কোনোভাবেই রেহাই পাচ্ছে না। ঢাকার বাতাসে দূষণের ভয়াবহতা নিয়ে দেশি বা বিদেশি সংস্থার যখনই কোনো প্রতিবেদন বের হয় তখনই দূষণকারী কর্তৃপক্ষ, দূষণনিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও সরকার নড়েচড়ে বসে।
সত্যি বলতে, বায়ুদূষণ থেকে যেটুকু স্বস্তি পাওয়া গেছে এই করোনা-কালেই! বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যত আলোচনা বা কথা হয় সে পরিমাণ কাজ হয় না! আর তা যদি হতো তাহলে পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থানের ধারাবাহিকভাবে অবনতি হতো না! পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণ, সামান্য বর্ষায় কাদা আর পুরো বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা যেন অমোঘ নিয়তি! ধুলাদূষণ শুধু নাগরিক জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে না, ঢাকার বাতাসে ভেসে বেড়ানো ভারী ধাতু মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তার ধুলাবালিতে সর্ব্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, নিকেল, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, আর্সেনিক, কপার ও ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
নিত্যদিনের চলাচলে এসব সূক্ষ্ম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা খুব সহজেই ত্বকের সংস্পর্শে আসে এবং শ^াসপ্রশ^াসসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাতাসে ভারী ধাতুর উপস্থিতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শহরগুলোর থেকে অনেক গুণ বেশি। শহরে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাজ, তীব্র যানজটের ফলে নির্গত ধোঁয়া, ঢাকা ও চট্টগ্রামের আশপাশের ইটভাটার দূষণ, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান ও শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ভারী ধাতু ধুলার সাথে যুক্ত হচ্ছে।
পুরনো যানবাহনের আধিক্য, ধাতু গলানোর কারখানার দূষণ ও ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচল ভারী ধাতুর অন্যতম উৎস। ট্যানারি ও ডাইং শিল্পসহ মাটি থেকে সীমিত পরিমাণ ভারী ধাতুও ধুলার সাথে মিশে বাতাসকে দূষিত করে তুলছে। রাস্তাঘাট ও ঘরের বাইরে তো বটেই; বাড়িঘরের মধ্যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে ও খেলার মাঠে ছড়িয়ে পড়ছে এসব ভারী ধাতুর দূষণ। বিশেষ করে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। দূষণের কারণে নগরবাসীর মধ্যে শ^াসকষ্ট থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন ধরে দূষণের শিকার হতে হতে শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসারসহ নানা ধরনের রোগবালাই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রায় সর্বাধিক উৎস ইটভাটা। আগামী দিনের ভবিষ্যৎ শিশুরা যদি শিশু বয়স থেকেই দূষণের শিকার হয় তাহলে পুরো জীবনেই তাকে এর ফল ভোগ করতে হবে! প্রতিবছর বহু শিশু বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। দূষণের কারণে শিশুর মেধা ও বুদ্ধিমত্তার ক্ষতি হচ্ছে। এসব কারণে গর্ভাবস্থায় শিশুর মৃত্যুর হার বাড়ছে! বায়ুদূষণ মোকাবিলায় এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বায়ুদূষণ রোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে আলোচিত ‘নির্মল বায়ু আইন’ পাস ও এর প্রয়োগ হলে বায়ুর মান আরও উন্নত হবে। ভয়টা যেখানে সেটা হলো কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ দরজায় কড়া নাড়ছে। শীতকাল আসন্ন। প্রকৃতি এখন শীতল হয়ে উঠছে, আকাশ স্বচ্ছ হচ্ছে, সকালে শিশির ঝরছে, তবুও বায়ুদূষণ থেকে রেহাই নেই। বিশ^ বায়ু পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী যেসব দেশের বায়ুর মান খারাপ, সেসব দেশে করোনা সংক্রমণ দ্রুত হবে। আর এটা তো সবারই জানা, আমাদের দেশে শুষ্ক শীতকালে বায়ুর মান বেশ খারাপ হয়। অক্টোবরে ব্যাপক বায়ুদূষণ শুরু হয় এবং তা ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত চলতে থাকে। বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকভাবেই নেই বললেই চলে, তাপমাত্রাও কম। অপরদিকে কুয়াশা বেড়ে যাওয়ায় বায়ুর মান আরও খারাপ হচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, চলতি শীতে দূষিত বাতাসে ভর করে করোনা সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। করোনা ভাইরাসের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ফুসফুস দূষিত বাতাসের ওপর ভর করে সংক্রমণকে নতুন মাত্রা দিতে পারে। তাই শীত মৌসুমে করোনা সংক্রমণ ঠেকানোসহ সামগ্রিকভাবে বায়ুদূষণ রোধে সতর্ক ও পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শুধু উন্নয়ন করলেই হবে না, উন্নয়নের সাথে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সমন্বয় করতে হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে বড় বড় শহরে রাস্তাসহ নির্মাণাধীন জায়গা ঘিরে দেওয়াসহ ধুলামাখা স্থানে দুবেলা পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ¦ালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। দূষণকারী কর্তৃপক্ষ যত শক্তিশালী হোক না কেন কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের সাথে জড়িত কর্তৃপক্ষকেও পরিবেশ সুরক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব নয়। সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় ও সতর্কতা থাকলে পরিবেশ রক্ষায় সুফল আসবে বলে মনে করি।

লেখক : পরিবেশকর্মী, কলামিস্ট
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫@মসধরষ.পড়স