বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে হালদার পানি

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

হালদা থেকে ওয়াসা চট্টগ্রাম মহানগরীর মানুষের জন্য প্রতিদিন ১৮ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করে। নির্মিয়মান মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে প্রতিদিন খাবার পানির জন্য ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং বা আই ডব্লিউ এম সম্প্রতি হালদা থেকে দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের একটি প্রকল্প গ্রহণ করার প্রস্তাব করেছে। দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য দেশে শতাধিক শিল্প জোন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এরই অন্যতম একটি শিল্প জোন ‘বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরী’ মিরসরাই চট্টগ্রামে প্রস্তুত হচ্ছে। ৩০ থেকে ৫০ হাজার একর জমিতে নানা ধরণের শিল্প কারখানা স্থাপিত হচ্ছে। দেশ-বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসছে। প্রাথমিকভাবে এখানে কর্মসংস্থান লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৫ লাখ মানুষের।
ইতিমধ্যেই জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কতিপয় দেশসহ ভারত ও অন্যান্য অর্থনীতির অগ্রসরমান দেশ এখানে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। প্রতিনিয়ত দেশিÑবিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে। বিশাল এই শিল্পজোন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশে ১৯৭২, ৭৩, ৭৪ সালে ব্যাপক বিনিয়োগ খরা ছিল। আন্তর্জাতিক অসহযোগিতা এবং ষড়যন্ত্র ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর দেশে দেশে বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছেন। বিনিয়োগ আসেনি। বাংলাদেশের জন্মের বাস্তবতাকে অনেকেই স্বীকার করতে চায়নি। দারিদ্র, খরার সাথে খাদ্য ঘাটতি। তার ওপর আন্তর্জাতিক কুচক্রি মহলের ষড়যন্ত্র। আমরা হেরে গিয়েছিলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ আমাদের আলো দেখিয়েছে। আমাদের উদ্যম, আমাদের সাহস, আমাদের একাগ্রতা আমরা হারাইনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অদম্য অগ্রযাত্রা ষড়যন্ত্রকারীদের হতাশ করেছে।
নদী মায়ের বাংলাদেশে হাজার নদীর মেলা, খেলা। হাজার নদীর অনন্য এক নদী হালদা নদী। এটি বিশেষায়িত নদী। কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন কেন্দ্র। বিশেষায়িত বিশেষজ্ঞ এবং প্রশাসকদের কর্মপ্রক্রিয়ায় এখানে কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর সাত মিলিয়ন মানুষের খাবার পানির সিংহভাগ আসে কর্ণফুলী হালদার কনফ্লুয়েন্স থেকে। হালদার গুরুত্ব তাই অপরিসীম। কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে এই নদী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমলা, প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, গবেষক হুমড়ি খেয়ে পড়ে এই নদীর কথা শুনে, এই নদীর কথা বলে। ঢাকা থেকেও নিয়মিত হালদাকে দেখতে চেষ্টা করেন অনেক সামাজিক গবেষক, কাগুজে গবেষক।
এভাবেই দেশের অপরাপর নদী থেকে এই নদীর ভক্ত -অনুরক্ত, প্রেমিক, চিন্তক, কথক, লেখক অনেক বেশি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখানকার বিশেষজ্ঞরা হালদার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও হালদা নিয়ে বিশেষায়িত প্রবন্ধ তৈরি হয়ে যায়। গবেষকের কৃত্রিম বিলাপ হালদাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। হালদায় পানির লবণাক্ততা, অন্যান্য মানদ- নিয়মিত পরীক্ষা না করেই তারা আহাজারি করেন। বেশ কয়েকজন গবেষক (?) রীতিমতো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেন।
মানুষ হিসেবে হালদার প্রতি সংবেদনশীলতার কারণে হালদার প্রতি অনুরাগ, আসক্তি দেখিয়ে কারো কারো উৎকণ্ঠা থাকতে পারে, উদ্বেগ থাকতে পারে। এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু উদ্বেগ যদি উন্মাদনায়, উৎকণ্ঠা যদি উচ্ছৃঙ্খলতার পরিণত হয়, তখন তা মেনে নেয়া যায় না। হালদায় পানির লবণাক্ততা (ক্লোরাইড ঘনত্ব) শুকনো মৌসুমে সাধারণত. ৫ থেকে ১০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে থাকে। হালদায় পানির লবণাক্ততা কাপ্তাই বাঁধের ওপরের পানির সংমিশ্রণে সব সময় মিনিমাইজ করা হয়। অতীতে চরম শুকনো মৌসুমে হালদার পানির লবণাক্ততা সহনীয় মাত্রা থেকে বেড়ে যেত। এটি খুবই সাময়িক। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হয়ে থাকত। তখন কাপ্তাই বাঁধের একটি রেগুলেটর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশনায় খুলে দিয়ে উপরের লেকের পানি আসার ব্যবস্থা করে লবণাক্ততা সহনীয় মাত্রায় রাখার চেষ্টা করা হয়। এটি এখন নৈমিত্তিক ঘটনা, প্রতি বছরের বিশেষ সময়ের। হালদার ওপর থেকে মিঠা পানির প্রবাহ বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ৭০ ভাগ কর্ণফুলীর পানির ওপরে হালদাকে জীবন পেতে হয়। হালদার মিশ্র পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বিওডি, সিওডি, তাপমাত্রা, খরতা, খারকতা, পিএইচ, অন্যান্য ধাতব পদার্থের মিশ্রণ এবং ইলেক্ট্রাইক্যাল কন্ডাক্টিভিটি, টিডিএস, টি এস, টিএসএস সবকিছু মিলিয়ে একটি অপটিমাম কন্ডিশন সৃষ্টি হয়। এরকম অবস্থায় মা মাছ ডিম ছাড়ে ।
দিনে দুইবার সাগরের পানি দ্বারা ফ্লাশ হওয়ার জন্য হালদা নিজেই নিজের সহনীয় অবস্থাকে প্রস্তুত করে, তৈরি করে রাখে। এটি প্রাকৃতিক। হালদার ওপরে অনেকগুলো স্লুইচগেট, রাবার ড্যাম, কীটনাশকের সংকট হালদাকে সংকটাপন্ন করে রাখে। গবেষকেরা এ নিয়ে তেমন আহাজারি করে না। মিঠা পানির ওপরের উৎস সীমিত। তাই চরম শুকনো সময়ে কাপ্তাই বাঁধের পানি ছেড়ে দিয়ে হালদার তথা চট্টগ্রাম শহরের সরবরাহকৃত পানিতে লবণাক্ততা মিনিমাইজ করার চেষ্টা করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হালদায় কার্প জাতীয় মাছ আসা-যাওয়ার ওপর থাকে। অন্যান্য খাল-নদী হয়ে সময়মত হালদায় এসে ডিম ছাড়ে। এই আসা-যাওয়ায় তাদের প্রাকৃতিকভাবে সহযোগিতা করে বৃষ্টি-বাদল, মেঘের গর্জন, তাপমাত্রা, আবহাওয়া প্রভৃতি।
হালদা থেকে মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে প্রতিদিন ১৪ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করলে হালদা থেকে সর্বসাকুল্যে ৩২ কোটি লিটার বা প্রবাহের ২.২৯ শতাংশ পানি উঠানো হবে। মিঠা পানির যে অংশ সাগরে বিসর্জিত হবে, সে পানি উঠিয়ে নিলে ফ্লোরা, ফাওনা, প্লাংটন ফাইটোপ্লাংটনের জীবননাশ হবে, এমন চিন্তা চেতনা আর যাই হোক গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে না। জোয়ার ভাটার মিঠাপানির একটি নদীর জন্য এটি একেবারেই অস্বাভাবিক, অবাঞ্ছিত, কোনো ঘটনা । মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্প জোনে হালদা কর্ণফুলীর সুযোগ বা কনফ্লুয়েন্স (সংযোগ থেকে ০.৫ কিমি ভিতরে) সাগরমুখী মিঠা পানি উঠিয়ে নিলে নদী শেষ হয়ে যাবে, এমন আহাজারিতে উন্মাদনা থাকে, গবেষণা থাকে না।
হালদা থেকে পানি নিয়েই শুধুমাত্র এই শিল্প জোন চলবে, তা কিন্তু নয়। অন্যান্য প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উৎস, ভূগর্ভস্থ পানি এবং ভবিষ্যতে পানির লবণ মুক্তিকরণের মাধ্যম দিয়ে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘এটি হালদার জীবন-মরণ সমস্যা হবে’। ‘মাছগুলো আর ডিম ছাড়বেনা’। ‘লবণাক্ততা বহুগুণে বেড়ে’ যাবে’- এইসব কথার সাথে গবেষণার সমন্বয় থাকা দরকার, সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। শুধুমাত্র হালদা থেকেই জন্ম-জন্মান্তরে এই প্রকল্প পানি গ্রহণ করবে, তা ভাবা কেন? এরকম ভাবনা তো মূর্খতাকে উস্কে দেয়, অজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে যায়। কথিত হালদা ল্যাবরেটরিতে কোন বিশেষজ্ঞের পদচারণা নেই। পানি বিশেষজ্ঞতো অবশ্যই নেই।
আমরা মনে করি না, হালদার পানিই মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্প জোনের খাবার পানির একমাত্র উৎস এ ধরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে। শতকরা ২.৯ ভাগ পানি হালদা থেকে উত্তোলন করলে হালদা শেষ হয়ে যাবে, হালদা পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা বদলে যাবে, কার্প জাতীয় মাছকে আর পাওয়া যাবে না -এইসব প্রশ্ন অবান্তর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করি।
আমাদের বিশ্বাসের সাথে মনে রাখতে হবে, হালদার কার্প জাতীয় মাছগুলো সেখানে সারা বছর বসবাস করে না। মাইগ্রেটরি পথ দিয়ে এরা হালদা, কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, ইছাখালী প্রভৃতি নদীতে আসা-যাওয়া করে বিচরণ করে, বিস্তৃত থাকে। শুধুমাত্র ডিম ছাড়ার আগের সময়ে এগুলি হালদার মত লবণমুক্ত, তাপমাত্রা সহনীয়, গ্রোথ উপযোগী পরিবেশে এসে ডিম ছাড়ে।
তাই ‘কার্প জাতীয় মাছের স্থায়ী আবাসভূম হালদা নদী, কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র স্থায়ী আবাসভূমি, একমাত্র বিচরণ কেন্দ্র’- এসব কল্পকাহিনী ভাবার, গবেষণা করার, চর্চা করার, প্রচার করার কোন যুক্তি নেই, সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত. ‘ডলফিনের নিরাপদ আবাসভূমি হালদা নদী’Ñএসব কল্পকাহিনীরও কোনো সুযোগ নেই। ডলফিন একই মাইগ্রেটরি নদীগুলোতে বিচরণ করে, আহার করে খাবার আহরণ করে এবং বেঁচে থাকে। তৃতীয়ত. প্রতি বৎসর হালদায় যে ডিমের সংখ্যা প্রচার প্রকাশ করা হয়, তা বস্তুনিষ্ঠ নয়।
চতুর্থত: ‘হালদাই পৃথিবীর কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রজনন ক্ষেত্র’ -এরকম মূর্খ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অজ্ঞতার বিস্তৃতি ঘটায়। পৃথিবীতে, এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারত এবং বার্মাতেও একই রকম প্রজননের সুযোগ আছে, থাকে, যার কারণে বাংলাদেশের কার্প জাতীয় মাছের বাজারে ভারত এবং বার্মার সরবরাহ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়াও সুদূর কানাডাসহ আমেরিকাতেও কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র আছে।
হালদায় বহুমাত্রিক গবেষকদের বিচরণ হালদাকে সংকটাপন্ন করে। প্রতিনিয়ত উত্যক্ত করে। জনগণের চিন্তা চেতনাকে বিভ্রান্ত করে, বিপথে নেওয়ার চেষ্টা করে। ফরমায়েশি লেখক-গবেষক হালদা গবেষণাকে বিস্তৃত হতে বাধা দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে খাবার পানি সরবরাহ করে বিদেশী উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার সুযোগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রত্যয়। এ প্রত্যয়ের বিকাশ ও বাস্তবায়নে বাধাদানকারীদের ডায়াগনোসিস হওয়া দরকার।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক
কর্ণফুলী গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত