প্রযুক্তিবিজ্ঞান ও মানবজীবনের অগ্রগতি

রায়হান আহমেদ তপাদার »

বর্তমান জগতের মানুষ বিজ্ঞান নির্ভর। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে করতে মানুষ নিজেও অনেক যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। নিজের স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ফেলেছে। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি মানুষের জীবনে যেমন আয়াস ও বিলাসিতা এনে দিয়েছে তেমনি অপর দিকে চাহিদাও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু দরিদ্র মানুষের তো সব চাহিদা পূরণ হয় না। তাই অনেকেই অসুখী ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম হয়ে পড়েছে মানুষের জীবন।
পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি-এ দুটি দিকেই একসঙ্গে গবেষণা হয়ে দুটি দিকই উন্নত হয়েছে। ফলে, জনসাধারণের জীবনের গুণমান সামগ্রিকভাবে উন্নত হয়েছে আবার পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতা ও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন বিজ্ঞানের কৌতূহলের দিকটিকেও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কিন্তু আধুনিক সময়ে এসে আমাদের প্রাচ্যের দেশগুলোয় জীবনের মান উন্নয়নের প্রযুক্তি কেবল যে উপেক্ষিত হয়েছে তা নয়, এ ধরনের প্রচেষ্টাকে সামাজিকভাবেও নিচু চোখে দেখা হয়েছে। যদিও মধ্যযুগের আরব বিজ্ঞানীরা প্রযুক্তি ও জ্ঞানের বিকাশে ইউরোপের সামনে পথিকৃতের ভূমিকায় এসেছিলেন, কিন্তু আজ যেন চলছে উল্টোযাত্রা। এর ফলাফল পরিষ্কার।
প্রযুক্তি বিবর্জিত হয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিণত হয়েছে জ্যোতির্বিদ্যায়, যেটি মোটেই আর বিজ্ঞান থাকেনি, ভূত-ভবিষ্যৎ গণনা করার দিকে চলে গেছে।অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির অভাবে বৃহত্তর জনসাধারণের জীবন-মান অতীতের মতোই রয়ে গেছে। বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তির সুফল তারা পাচ্ছে খুব সামান্যই।
সব মিলিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের স্থান কোথায়, তাও পরিষ্কার করে বলে দিতে হবে না। মানবগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৮০ ভাগের জন্য এ একই চিত্র, যারা আজ তথাকথিত ‘তৃতীয় বিশ্বের’ অধিবাসী। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনকে সামনে রেখে, তাদের উপযোগী করে স্থানীয়ভাবে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করে ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া এ অবস্থার পরিবর্তন আসবে না।
বিজ্ঞানচর্চার দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে অজানাকে জানার চেষ্টা, অপরটি হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে মানুষের জীবনের মান উন্নত করা। নিয়ন্ত্রিতভাবে আগুন জ্বালানোর প্রযুক্তি যেদিন মানুষ আবিষ্কার করে, সেদিন থেকেই মানুষের সভ্যতার শুরু মনে করা হয়। এ জন্য সভ্যতা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল, এক কথায় বলা যায়। আবার প্রযুক্তির উন্নয়ন এমন সব যন্ত্রপাতি উন্নয়নে সাহায্য করে, যার মাধ্যমে অজানাকে জানার পদ্ধতিকে আরও উন্নত করে বিজ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দেয়। সে উন্নত বিজ্ঞান আরও উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে মানুষের জীবনের মানকে আরও বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এভাবে হাত ধরাধরি করেই চলে আসছে আদিকাল থেকে। আসলে বিজ্ঞান হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যাবহারিক কার্যক্রম-যার মাধ্যমে ভৌত ও প্রাকৃতিক বিশ্বের গঠন ও চরিত্রকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের দ্বারা সুশৃঙ্খলভাবে অধ্যয়ন করা হয়। আর প্রযুক্তি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ব্যাবহারিক প্রয়োগ, বিশেষ করে শিল্পের ক্ষেত্রে।
সেই হিসেবে আজ আমরা বিজ্ঞান বলতে যা বুঝি, মানব ইতিহাসের শুরুতে তা এভাবে ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে একসময় প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান দুটি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হলেও এখন তা মিলেমিশে অনেকটাই একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিজ্ঞান বলতে আমরা সাধারণভাবে প্রযুক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করে থাকি। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও তথ্যের আদান-প্রদানে প্রবেশাধিকার, প্রমাণভিত্তিক নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিজ্ঞানকে বৈশ্বিকভাবে উন্মুক্তকরণের পক্ষে ইউনেসকো সুপারিশ করেছে। কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ও মহামারি মোকাবেলার জন্য বিশুদ্ধ নিরাপদ পানি ও উন্নত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা অপরিহার্য বলে ইউনেসকো উল্লেখ করেছে। পানি নীতিমালা তৈরি ও পানিসম্পদের সুস্থায়ী ব্যবস্থাপনাসহ উন্নত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা তৈরির জন্য ইউনেসকোর পক্ষ থেকে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের কথাও বলা হয়েছে। বাস্তুতাত্ত্বিক পুনর্গঠনের জন্য ইউনেসকো জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সমন্বিত পদ্ধতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়েছে। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের সুস্থায়ী ব্যবহার ও উন্নয়নের ওপর ইউনেসকো গুরুত্ব দিয়েছে। এসব কাজ করার জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সহযোগিতা ও অর্থায়ন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমানে কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়টি নিয়েও বিভিন্ন দেশের কয়েকটি গবেষণাগারের পক্ষ থেকে তথ্য কিংবা নমুনা চুরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার পথ ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টির সমাধান খোঁজা দরকার। বিজ্ঞান যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, সমাজ তার সঙ্গে মিল রেখে এগোতে পারছে না। তৈরি হচ্ছে সংকট। কয়েক দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজাক অ্যাসিমভ বলেছিলেন, আমাদের জীবনে সব থেকে দুঃখের বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞান যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, সামাজিক প্রজ্ঞা সেই গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে বিজ্ঞানের অপব্যবহার প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। আমরা বিজ্ঞানকে যতটা না ব্যবহার করছি মানুষের রোগব্যাধি নিরাময় তথা মানবকল্যাণের জন্য-তার থেকে অনেক বেশি ব্যবহার করছি যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে মানুষ মারার জন্য। প্রকৃতি আর পরিবেশ ধ্বংস করার জন্য। অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য। এসব বিষয় পর্যালোচনা করলে বিজ্ঞান ব্যবহারে আমাদের সামাজিক প্রজ্ঞার ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমাজের জন্য ও সমাজের সঙ্গে বিজ্ঞানকে দেখতে হলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।
বিজ্ঞানকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না, যা প্রকৃতি-পরিবেশ তথা মানবকল্যাণের বিরুদ্ধে যায়। বিজ্ঞানের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করার মূঢ়তা ত্যাগ করতে হবে। সমাজ অগ্রগতির স্বার্থেই কুসংস্কার পরিহার করা উচিত। বিজ্ঞানমনস্ক সমাজই পারে বিজ্ঞানকে অপব্যবহার থেকে রক্ষা করে তাকে শান্তি ও উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করতে।
অপরদিকে সমাজ অগ্রগতির পেছনে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর ভূমিকা অপরিসীম। তবে বিজ্ঞান ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মতে, আদিতে বর্তমান মানবপ্রজাতি কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানবসদৃশ প্রজাতিগুলো ক্ষুধা ও প্রকৃতির বিরূপতা জয় করার জন্য প্রথমে প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছিল। প্রকৃতির অন্য অনেক প্রজাতির মধ্যে প্রযুক্তিগত বিষয় সহজাত হলেও মানবপ্রজাতির জন্য তা ছিল অর্জনের, শিক্ষণের ও জ্ঞানের। বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশের সূচনা ঘটেছিল এভাবেই। পৃথিবীজুড়ে এখন বড় দুঃসময় চলছে। বিগত কয়েক মাসে আমাদের চেনা পৃথিবীটা অনেকটাই পাল্টে গেছে। এখন আমরা অপেক্ষা করছি, কবে আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। সেই সঙ্গে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি একটি কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য। তাকিয়ে আছি গবেষণাগারগুলোর দিকে, যেখানে বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে এ জন্য কাজ করে চলেছেন।
আমরা বুঝতে পারছি ও বিশ্বাস করছি গুটিবসন্ত, হাম, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, হুপিং কাশি, হেপাটাইটিস বি, পোলিওর মতো ভয়ংকর সংক্রামক রোগগুলোর ভ্যাকসিন যেমন বিজ্ঞানের অবদান, তেমনি কভিড-১৯-এর সমাধানও আনবে বিজ্ঞান। প্রযুক্তিবিজ্ঞানের সাহায্যে কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব এসেছে। আজকের ভারত খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ চিকিৎসায় এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। দুরারোগ্য কঠিন ব্যাধির চিকিৎসা করে নিরাময় করা হচ্ছে নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে। প্রযুক্তিবিজ্ঞানের আবিষ্কার আমাদের রোজকার জীবনযাত্রায় এনেছে অভূতপূর্ব সাফল্য।
আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরী মোবাইলের সাহায্যে পথ চলতে চলতেও প্রয়োজনীয় অনেক কাজ করে ফেলা যাচ্ছে। প্রচন্ড গরমেও এসি ঘরে বসে অনেক কঠিন কাজ করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। মোট কথা বিজ্ঞান আমাদের জীবনে যেমন আরাম এনে দিয়েছে তেমনি জীবনের চলার পথকেও অনেক সহজ ও গতিময় করেছে।
কিন্তু অসুখী বা অসহিষ্ণুতা নিজেদের অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়। এগুলো বাদ দিলে বিজ্ঞান আমাদের পরম বন্ধুর মতো। একে বাদ দিয়ে মানব সভ্যতা অচল। প্রযুক্তিবিজ্ঞানকে আরো বেশি করে কাজে লাগিয়ে তার সুফল প্রত্যেক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তবেই একটা দেশ স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স