পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করুন

সুভাষ দে »

ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ ১ম ধাপে দেশের ২৫টি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জানুয়ারির মাঝামাঝি ৬১ টি এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য পৌরসভাগুলির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে আগ্রহীরা বড়ো দু দলের নেতাদের কাছে যাচ্ছেন। বিএনপিও পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে, এটি নিশ্চয়ই ভাল খবর। আমরা আশা করি অতীতের নির্বাচনগুলির মতো নামকাওয়াস্তে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কিংবা নির্বাচনের দিন মাঝপথ থেকে সরে পড়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে বিবৃতি দেয়া কাক্সিক্ষত নয়। তাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে নির্বাচনে নানা ধরণের অনিয়ম, কারচুপি, জাল ভোট প্রদান, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে বিভিন্ন কায়দা করে বাধা দেওয়া, নির্বাচনের পূর্বাপর নানা সহিংস ঘটনা যা বন্ধ করতে নির্বাচন কমিশনের যথাযথ ভূমিকা না নেওয়া, যার ফলে ভোটারদের মনে ভীতির সঞ্চার করে এবং তাদের ভোট কেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিত করে ইত্যাদি। এছাড়া আছে সরকারের গ্রেফতার, দমন নিপীড়ন এবং প্রতিপক্ষের আগ্রাসী মনেভাবের কারণে বিএনপি প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় যথাযথভাবে অংশ নিতে না পারা ।দেশের প্রধান বিরোধী দল যারা কয়েক দফায় দেশ শাসন করেছে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা (যেটি তারা অতীতে করেছে), কিংবা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও এক সময় নির্বাচন থেকে সরে পড়া, নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে না যাওয়া এবং এর ফলে সংসদে কিংবা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনে সরব ও সক্রিয় প্রতিনিধিত্ব না থাকায় নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা সঠিক মানদ-ে বিবেচ্য হয় না।
গণতন্ত্রে শক্তিশালী বিরোধীদলের অবস্থান ছাড়া এটি শক্তিশালী ও কার্যকর হয় না। আর গণতন্ত্র শক্তিশালী ও কার্যকর না থাকলে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক পথে সরকার পরিবর্তন বা ক্ষমতা দখলের প্রবণতা জোরদার হয়। এটি জাতি ও জনগণের জন্য কখনো শুভ নয়। কিছু মানুষের তরক্কি হয় কিন্তু জনগণের মধ্যে বৈষম্য বাড়ে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার যে সকল উপাদান জাতি ও রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করে, অর্থনৈতিকÑসামাজিকÑসাংস্কৃতিক অভিযাত্রা যেভাবে মসৃণভাবে চলতে থাকে তাতে বিশ্বসভায় দেশটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। আবার গণতান্ত্রিক সরকার থাকলেও কিংবা নির্বাচন হলেও যদি গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা, আইনের শাসন, প্রশাসনের নিরপেক্ষ আচরণ, সুশাসন ও জনগণের অংশগ্রহণ স্থানীয় প্রশাসনে সম্পৃক্ত করতে না পারলে গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের আড়ালের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয়। আমরা অতীতে সামরিকÑস্বৈরাচার আমল দেখেছি। কয়েকটি গণতান্ত্রিক সরকারও দেখেছি কিন্তু গণতন্ত্রের যে সর্বজনীন রূপ, জনগণের প্রত্যাশার পূর্ণতা, উন্নয়নÑঅগ্রগতির সুফল জনগণের কাছে সুষমহারে সম্পদ বণ্টন তা হয়নি। দেশের সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে। ধনীদের বিকাশের তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশ সর্বাগ্রেÑএ ধরণের খবরও বিশ্বের নানা গণমাধ্যমে এসেছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতির দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দেশে ধন এবং ধনিক শ্রেণির স্ফীতি কিভাবে সম্ভব! এটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং এ ধরণের বৈষম্য সামাজিক সুস্থিরতা বিপন্ন করে তোলে।
নির্বাচন গণতন্ত্রকে পূর্ণতা দান করে কেননা এর মাধ্যমে গণ রায়ের অভিব্যক্তি ঘটে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা নিশ্চিত হয়। জনগণ তাদের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচন করে নিজেদের সক্রিয়তা এবং দেশ শাসনের সম্পৃক্ততায় নিজেকে অভিষিক্ত করে। কিন্তু আমরা বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনে ব্যত্যয় দেখেছি। এসব নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচন, মনোনয়ন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা, নির্বাচনী আইনের বরখেলাপসহ নানা ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়েছে তাতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সমালোচিত হয়েছে এমন কি নির্বাচন কমিশনের মধ্যে নানা ইস্যুতে দ্বিমত, অন্তর্বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে।
বড় দলগুলির প্রার্থী নির্বাচনে তৃণমূলের মতামত তেমন বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, ২০১৯ এর জাতীয় সংসদের প্রার্থী মনোনয়নে বিএনপিতে দফায় দফায় প্রার্থী পরিবর্তন হয়েছে।
স্থানীয় সরকার পরিষদগুলির নির্বাচনে নির্বাচনের পূর্বাপর ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। অথচ নির্বাচন কমিশন তা কঠোরভাবে দমন করতে পারেনি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে আসে, সে ক্ষেত্রে এতসব সহিংসতা, অনিয়মের দায় নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না। এ ধরণের সহিংসতা দল, পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজকেও আক্রান্ত করে এবং এর রেশ দীর্ঘসময় পর্যন্ত চলতে থাকে যা সামাজিক সম্পর্ককে দ্বন্দ্বÑসংঘাতে ঠেলে দেয়। ফলত নির্বাচনে এ ধরণের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া মানুষকে নির্বাচনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে ভোট কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করে। জাল ভোট প্রদান কিংবা জোরপূর্বক সিল মারার ব্যাপারটিও ভোটারদের হতাশ করে। এতে করে সে তার প্রাপ্য নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এরূপ মনোভাব গড়ে ওঠে।
দেখা গেছে, সাম্প্রতিককালে শহরের এলাকায় উপÑনির্বাচনে ভোট খুবই কম পড়েছে। এতে জনগণের মতামত সত্যিকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তা বলা যায় না। অবশ্য করোনার কারণে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। তবে এতটা কম হবে কেন, অথচ গ্রামাঞ্চলে এ ধরণের নির্বাচনে মোটামুটি ভাল ভোট পড়েছে।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে রাজনৈতিক দল, প্রার্থীর দায়িত্ব বেশি। যেখানে ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনা করার কথা, দেখা গেছে প্রার্থীরা সেভাবে তাদের কাছে যাননি। করোনার সময় বিকল্প পদ্ধতিও আছে। অনলাইন, ফেসবুকে এবং অন্যান্যভাবে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, বাসায় বাসায় লিফলেট প্রার্থী পরিচিতি কার্ড, ভোটারদের নাম ঠিকানা কেন্দ্র সম্বলিত কার্ড পৌঁছে দেওয়াÑএসব জনসংযোগের কার্যকরী মাধ্যম। বাম দলগুলি ভোটে যেতে আগ্রহী নয়, এটি সঠিক কৌশল নয়। বরং তাদের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে এবং সমাজের হিতকরী পথ তুলে ধরতে তাদের নির্বাচনে যাওয়া উচিত। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে (পৌরসভায়, জেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে) তাদের শক্তিশালী অবস্থানগুলিতে প্রার্থী দিতে পারে। এতে প্রচারণায় নতুনত্ব আসবে। গণতন্ত্র চর্চায় এবং প্রায়োগিক দিক থেকে বুর্জোয়া দলগুলির চাইতে বামÑপ্রগতিশীল দলগুলি অপেক্ষাকৃত ভাল ভূমিকা রাখতে পারে।
আগামী ২৮ ডিসেম্বর সীতাকু- পৌরসভার নির্বাচন। দ্বিতীয় ধাপে ৬১টি পৌরসভার নির্বাচন হতে পারে। যে সব পৌরসভার মেয়াদ শেষ অথবা জানুয়ারিতে হয়েছে বা শেষ হবে সামনে সেগুলির ভোট পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
করোনার কারণে চসিক এর নির্বাচন আগে স্থগিত করা হয়েছে। বড় দুই দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা এখন জনসংযোগ করছেন।
আমরা মনে করি, দেশব্যাপী পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠান যথাযথ ও সুচারু, সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন যথাযথ ভূমিকা রাখবে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং প্রশাসনে জনগণের সম্পৃক্তি নিশ্চিত করতে এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনার মধ্যেও জীবন জীবিকার সংগ্রাম একই সাথে চলছে। নির্বাচনকেও জীবনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে শিখতে হবে। প্রার্থীরা, দলীয় কর্মীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিকল্পনা করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। ভোটের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক দায়িত্বের কথাও মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। আমরা নির্বাচনের প্রচারে কিংবা নির্বাচনের দিন কোনরূপ সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা দলীয় তা-ব দেখতে চাই না। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই বিধি প্রয়োগে কঠোর হতে হবে।
পৌর নির্বাচন উৎসবমুখর হোক, প্রার্থী যারা জনপ্রতিনিধি হবেন তারা নির্বাচনকে একটি সুচারু সংস্কৃতির রূপ দিতে পারেন। তবেই আমাদের নির্বাচনী আদল পরিবর্তনের রূপ পেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক