পায়ে ধরেও মিলল না একটু অক্সিজেন!

চট্টগ্রামে ভেঙ্গে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা!
কয়েকটি হাসপাতালের আইসিইউ সেবা বন্ধ, বাকিগুলোতে খালি নেই কোনো আইসিইউ শয্যা #
এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে মারা যাচ্ছে রোগীরা #
করোনাকালে ভিকটিম হচ্ছে অ-করোনা রোগীরা#

চমেক হাসপাতালেও সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অ-করোনা রোগীরা#

সালাহ উদ্দিন সায়েম :
নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা ফাতেমা মাহবুব (৫২) গত ২১ মে ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখান থেকে তাকে নেওয়া হয় ১৪ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত এই নারীর একটু জ্বর ও শ্বাস কষ্ট থাকায় চিকিৎসকরা সন্দেহ করে তার কোভিড-১৯ পরীক্ষার নমুনা নেন। কিন্তু ল্যাব থেকে নমুনার ফল আসার আগেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২৩ মে তাকে জোরপূর্বক করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে স্থানান্তর করতে চায়। তার নমুনার ফলাফল আসার আগেই স্বজনরা আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগীকে ভর্তি করাতে অনীহা প্রকাশ করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ছাড়পত্র দিয়ে দেন। হাসপাতালের এমন আচরণে বেকায়দায় পড়ে যান ওই নারী।
নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি না করায় ফাতেমা মাহবুবকে তার স্বজনেরা বাসায় নিয়ে যেতে বাধ্য হন। রাত ১০ টার দিকে তার করোনার নমুনার নেগেটিভ ফলাফল আসে। কিন্তু ততক্ষণে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। বেড়ে যায় তার শ্বাসকষ্ট। রাতে স্বজনেরা রোগীকে নিয়ে নগরীর আগ্রাবাদ থেকে পাঁচলাইশ পর্যন্ত অন্তত সাতটি হাসপাতালে ছুটোছুটি করেন। কিন্তু কোথাও আইসিইউ সেবা বন্ধ, আবার কোথাও আইসিইউ শয্যা খালি না থাকায় তাকে ফেরত দেওয়া হয়। ঘুরতে ঘুরতে একসময় অ্যাম্বুলেন্সের সিলিন্ডার অক্সিজেনের সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। রোগীর তখন শ্বাস নিতে তীব্র কষ্ট হতে থাকে। একপর্যায়ে পাঁচলাইশে একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকের পা ধরে একটু অক্সিজেনের ব্যবস্থা করার জন্য আকুতি করেন ওই নারীর স্বজন। কিন্তু তাতেও সাড়া মেলেনি। অবশেষে সেই হাসপাতালের সামনে রাস্তার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
চট্টগ্রামে ফাতেমা মাহবুবের মতো অনেক অ-করোনা রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।
করোনা পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যসেবা অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে। জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীরা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। নগরীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই। এতে মুমূর্ষ রোগীরা এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে মারা যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে শনিবার থেকে আইসিইউ শয্যার সংকট দেখা দেয়। নগরীর মেট্টোপলিটন হাসপাতাল, মেডিকেল সেন্টার, সিএসসিআর হাসপাতাল এবং আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিট বন্ধ থাকাতে এই সংকট দেখা দেয় বলে জানা গেছে। এ চারটি হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগীর করোনা পজিটিভ ফলাফল আসার পর লকডাউন করা হয়। এ চারটি হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিট বন্ধ থাকাতে অন্য হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়ে গেছে।
হঠাৎ আইসিইউ রোগীর চাপ কেন বেড়েছে?
নগরীর কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসকরা দীর্ঘ দিন ধরে চেম্বার বন্ধ রাখায় নানা বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। এসব রোগীরাই এখন হাসপাতালে এসে ভর্তি হচ্ছেন। যাদের অনেকে আইসিইউ ইউনিটে ভর্তি হচ্ছেন।
নগরীর মেহেদীবাগ ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খান সুপ্রভাতকে বলেন, চিকিৎসকরা দীর্ঘ দিন ধরে চেম্বার বন্ধ রেখেছেন। এতে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। এসব রোগীরাই এখন হাসপাতালে এসে আইসিইউতে ভর্তি হচ্ছেন। তাই এখন কোনো হাসপাতালে আইসিইউ খালি পাওয়া যাচ্ছে না।
মুমূর্ষ রোগীরা যাবে কোথায়?
চট্টগ্রামের করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে চারটি হাসপাতালে। চমেক হাসপাতাল, আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল, ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি ও হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল। এরমধ্যে কেবল জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য মাত্র ১০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এই ১০টি শয্যায় চিকিৎসকরা কাকে রেখে কাকে চিকিৎসা দেবেন সে সিদ্ধান্ত নিতে তাদের প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে।
আর চট্টগ্রাম সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০টি আইসিইউ শয্যায় তো সবসময় রোগী ভর্তি থাকে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম নগরীতে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ১১০টি।
নগরীর সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে এখন আইসিইউ শয্যা খালি না থাকায় প্রশ্ন উঠেছে, মুমূর্ষ রোগীরা এখন যাবে কোথায়?
কোনো মুমূর্ষ রোগীর চিকিৎসার এক পর্যায়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা যায়।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর সুপ্রভাতকে বলেন, মূলত করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার সংকট দেখা দিয়েছে। এখন হাসপাতালগুলোতে রাতারাতি আইসিইউ শয্যা বাড়ানো যাবে না। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এটা বাস্তব চিত্র। এই সীমাবদ্ধতার ভেতর আমাদের লড়াই করতে হবে।
হাসপাতালে অ-করোনা রোগীদের কেন চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে না
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে দেশের সকল হাসপাতালে করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার পাশাপাশি এ ভাইরাসে আক্রান্ত নয় এমন রোগীদেরও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। মন্ত্রণালয় বলছে, হাসপাতাল থেকে কোনো রোগী ফিরিয়ে দেয়া যাবে না।
মন্ত্রণালয় এমন নির্দেশনা দিলেও তা মানা হচ্ছে না। নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ উঠছে যে, তারা রোগী ভর্তি একেবারেই নিচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালগুলোতে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি নিলেও করোনার ফলাফল না আসা পর্যন্ত সেসব রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে না। এতে অনেক রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।
নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা ফাতেমা মাহবুবকে (৫২) গত ২৩ মে চমেক হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র না দিলে তিনি পরদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন না বলে মনে করছেন তার পরিবার। একটি বেসরকারি কলেজের অর্থনীতির শিক্ষক ওই নারীর জ্যেষ্ঠ কন্যা শারমিন মাহবুব সাথী সুপ্রভাতকে অভিযোগ করে বলেন, ‘চমেক হাসপাতালে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে আমার মাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়। এর মধ্যে তাঁর রক্তের প্রয়োজন হলে আমরা দু-ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করি। মায়ের অবস্থার তখন কিছুটা উন্নতিও ঘটে। ২১ মে দুপুরে তাঁর করোনা নমুনা নেওয়া হয়। বলা হয় ২৩ মে রাতে রিপোর্ট দেওয়া হবে। হঠাৎ করে ২৩ মে দুপুরে তাঁকে জোরপূর্বক করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে স্থানান্তর করতে চাইলে মায়ের অবস্থা বিবেচনায় আমরা অনেক অনুনয়-বিনয় করে তাঁকে অন্তত করোনার রিপোর্ট আসার আগ পর্যন্ত ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের শয্যাতেই রাখতে বলি। কিন্তু তারা সাফ বলে দেন রিপোর্ট  নেগেটিভ এলেও তাঁকে আইসোলেশন ওয়ার্ডেেই যেতে হবে অন্যথায় আমরা যেন রোগীকে বাড়িতে নিয়ে যাই। একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আমার মায়ের মুখ থেকে অক্সিজেন খুলে নিয়ে তারা ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। অথচ তখনো আমার মায়ের শয্যার পাশের তিনটি শয্যা খালি পড়ে ছিল। রাতে যখন রিপোর্ট পাই তাঁর করোনা নেগেটিভ, ততক্ষণে অবস্থা শংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। রাতব্যাপী হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটোছুটি করেও আমরা আর মাকে বাঁচাতে পারিনি। অক্সিজেনের অভাবে কষ্ট পেতে পেতে তিনি চলে গেলেন।’
তিনি বলেন, ‘যদি করোনার রিপোর্ট আরো আগে পাওয়া যেত কিংবা রিপোর্ট আসা পর্যন্ত ওরা মায়ের অক্সিজেন সেবা কেড়ে না নিত তাহলে হয়ত আমাদের মাকে হারাতে হতো না।’ ‘আবেগ-বিবেকহীন’ চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে ধিক্কার জানান।
এ ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের ১৪ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডের অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার বলেন, করোনা পরীক্ষার রেজাল্ট আসার আগে তো রোগীকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রেফার করার কথা নয়, তবে অনেক সময় রোগীর লক্ষণ দেখে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রেফার করা হয়।
আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগীকে রেফার করার পর যদি নেগেটিভ রেজাল্ট আসে তখন কী হবে? এই প্রশ্নের তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর সুপ্রভাতকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে কোনো রোগী ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশনার পরও অনেক হাসপাতাল থেকে অ-করোনা রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে নগরীর কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালকে ইতোমধ্যে সতর্ক করা হয়েছে।