পরিবেশ দূষণ রুখতে প্রয়োজন গণসচেতনতা

রতন কুমার তুরী »

গ্রাম থেকে শহরে, গঞ্জ থেকে নগরে সব খানেই পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। অসংখ্য প্লাস্টিক বোতল, জার, পলিথিন ডোবা নালায় আটকে থেকে শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টিসহ পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে চলেছে। অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষায় অতি প্রয়োজনীয় বৃক্ষ, বন, পাহাড় কেটে মানুষ অবিরামভাবে গড়ে তুলছে জনবসতি। এতে দিনের পর দিন পরিবেশ দূষণ বেড়েই চলেছে। পরিবেশের জন্য কোন দেশে সর্বমোট ২৫% বনভূমি সংরক্ষিত থাকার জন্য জরুরি হলেও তা এখনও গড়ে তোলা সম্ভব হয় নাই। বরং দেশের পাহাড়খেকো, ভূমিদস্যু আর বন উজাড়কারীদের বদৌলতে দিন দিন কমেই চলেছে পরিবেশ ভারসাম্যের জন্য প্রয়োজনীয় এসব উপকরণগুলো।
আমরা শুধুমাত্র বর্তমানের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করে জীবনের সব কিছুই বিসর্জন দেই। নিত্যদিন বনভূমি উজাড় হলে, পাহাড় কেটে জনবসতি গড়ে তুললে সব জায়গায় প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে অন্ধকারে তলিয়ে যাবে তা নিয়ে আমরা কেউ ভেবেও দেখি না। বাংলাদেশে গ্রামের অঞ্চলের চেয়ে শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে অসংখ্য মানুষ শহরে এসে বসবাস করে। শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে চসিক এর বেশ কিছু পরিচ্ছন্ন কর্মচারি এবং কর্মকর্তা দিনরাত পরিশ্রম করা সত্ত্বেও দেখা যায় বিভিন্ন নালায় অসংখ্য প্লাস্টিকের বোতল এবং পলিথিন জমে আছে আর এর জন্য নালায় ময়লা পানি জমে থাকে মাসের পর মাস এবং সেই নোংরা ময়লা পানিতে জন্ম হয় মশা।
তাছাড়া এসব প্লাস্টিকের জিনিস না পুড়িয়ে নালাতে ফেলে দেয়ায় চারিদিকে পরিবেশ দূষণ ছড়াচ্ছে। অথচ আমরা যারা এসব প্লাস্টিকের জিনিস নালায় ফেলছি তারা যদি একটু সচেতন হয়ে তা নগরীর সংরক্ষিত ডাস্টবিনে ফেলি তাহলে আমাদের এমন পরিবেশ দূষণের শিকার হতে হতো না। অন্যদিকে নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় সুন্দর গাছ এবং বসার জন্য মনোরম জায়গা থাকা সত্ত্বেও আমরা সেই গাছ ভেঙে দিই এবং বসার জায়গাসমূহ নোংরা করে ফেলি এতে করে উক্ত জায়গাটি একসময় পরিবেশ দূষণ ঘটায়। অথচ উক্ত জায়গাটি আমরা সবাই মিলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে ব্যবহার করতে তাহলে পরিবেশও ঠিক থাকতো আর আমরা একটি পরিচ্ছন্ন জায়গাও পেতাম। পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে শুধু কোনো দেশের সরকারের ওপর সব ছেড়ে দিলে চলবে না কারণ দেশের একটি বিশাল ভূখ-ে সরকারের একার পক্ষে পরিবেশের সব কিছু ঠিক রাখা সম্ভব নয়।
পলিথিনের জিনিস ব্যবহার করে তা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা কিংবা পুড়িয়ে ফেলা এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব । আমরা যদি এই দায়িত্ব সবাই সঠিকভাবে পালন করি তাহলে শহরের নালাগুলো পরিষ্কার থাকবে, তাতে পানি আটকে থাকতে পারবে না এবং পরিবেশ দূষণও হবে না।
অন্যদিকে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদসমূহে এখনও অনেক বনজ সম্পদ রয়েছে, রয়েছে পাহাড়, ডোবা, পুকুর ইত্যাদি, এসব বন, পাহাড়, পুকুর, ডোবা আমাদের পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এসবই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে আমাদেরকে নির্মল বাতাসে বসবাসের ব্যবস্থা করেছে। এটি প্রকৃতি প্রদত্ত এ বিষয়ে আমরা মাথা ঘামাই না অথচ এর ব্যত্যয় ঘটলে যে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনেক ভয়াবহ হবে তা একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়। বন উজাড়ের ফলে আমাদের পরিবেশে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে যাবে এবং দেখা দেবে পরিবেশ বিপর্যয়। অন্যদিকে পাহাড়, পুকুর, ডোবা যদি না থাকে তাহলে প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণিরা তাদের খাদ্য এবং আবাস হারাবে, এতে তাদের বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে যাবে।
প্রকৃতপক্ষে পরিবেশ দূষণ বা এর বিপর্যয় রুখতে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও কিছু করণীয় রয়েছে। আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে পরিবেশ দূষণ অনেকটাই কমে যাবে। যেমন- বন, পাহাড়, বৃক্ষাদির প্রতি যদি আমরা একটু সদয় হই, সব মানুষদের বুঝিয়ে বলি যে বন,পাহাড়, বৃক্ষ নিধন করলে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাবে এবং এক সময় রুষ্ট হয়ে প্রতিশোধ নেবে তাহলে হয়তো এর সুফল পাওয়া যাবে। তবে এ বিষয়ে মিডিয়াতে বিরামহীন প্রচার প্রচারণা সবসময় চলমান থাকতে হবে প্রয়োজনে পরিবেশ দূষণ রোধে আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে।
শুধু পরিবেশ দূষণ নয়, প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর মানুষের জবরদখল, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়নের জন্য বনভূমি সংকোচন ও বনভূমি উজাড়, আগুন লাগিয়ে অরণ্যের বিনাশÑএসব কারণে বিশ্বে বন্যপ্রাণির সংখ্যা দুইÑ তৃতীয়াংশেরও বেশি কমে গেছে বলে ওয়ার্লড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের (ডব্লিউডব্লিউএফ) এক বিস্তৃত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রাণিবৈচিত্র্যের এই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানবজাতির জন্য বিপদ সংকেত। এর ফলে আমরা আমাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ঝুঁকিতে ফেলছি।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক